আধ্যাত্মিক সাধনা ও ত্বরীকতের গুরুত্বঃ
আমরা জানি উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসার হয়েছে সূফী সাধকগণের প্রচেষ্টায়। এ কারণে বাংলার মুসলমানদের অন্তরে এখনো মাহবুবে সুবহানী, গাউছে ছামদানী, কুতবে রাব্বানী বড়পীর হযরত আশ-শায়খ মহীউদ্দীন আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ.), হযরত শায়খ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরী (রাহ.), হযরত শাহ্ জালাল ইয়েমেনী (রাহ.), হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ (রাহ.), ফুরফুরা শরীফের হযরত শাহ্ আবু বকর ছিদ্দিকী (রাহ.), হযরত শাহ সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী (রাহ.) ও চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত শাহ্ আমানত (রাহ.), শাহ্ বদর (রাহ্.), হযরত শাহ মিসকীন (রাহ.) ও বার আউলিয়ার ন্যায় বুযুর্গানে দ্বীন অমর হয়ে রয়েছেন। একই কারণে তাছাউফ বা পীর মুরিদী তরীকার প্রতি সাধারণভাবে সব মানুষের ভক্তি-আকর্ষণও অপরিসীম।
কিছু সংখ্যক পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি রসালো ভাষা ও আকর্ষণীয় লেখনীর মাধ্যমে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে নিজেদের ভাবধারার সাথে মিশ্রিত করে বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করছেন এবং মর্ডান ইসলামের স্বপ্ন দেখছেন। আসলে নবী করীম (সা.) এর প্রকৃত ওয়ারিশগণের মাধ্যমে কুরআন-হাদীসের সরাসরি শিক্ষা লাভ করার সৌভাগ্য না হওয়ার কারণে দ্বীনে ইসলামের রূহ বা প্রাণ সত্ত্বা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। তারা শুধু কোরআন শরীফের জাহেরী অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। অথচ কোরআন মজিদের জাহেরী ও বেতেনী উভয় জ্ঞানের সমন্বিত রূপই হচ্ছে ইসলাম।
দুনিয়ার জীবনে যেমন কোন লাভজনক ব্যবসার সফরে পথিমধ্যে চোর ডাকাতের আক্রমণের আশঙ্কা থাকে, তেমনি আল্লাহর পথে সাধনাকারীদের মধ্যে যে কিছু বাতেনী নেয়ামত ও রূহানী দৌলত রয়েছে সেগুলো লুণ্ঠনের জন্যও চোর ডাকাত রয়েছে। অবশ্য পীর ফকীরের নামে যেসব ভন্ড আল্লাহর পথিকদের শিকার করবার জন্য বিভিন্ন দরবার সাজিয়ে বাজার বানিয়েছে, প্রকৃত পক্ষে তারাই ইসলাম ও তাছাউফের বদনাম। এসব অপকর্ম দেখে কেউ পীর-মুরিদী সম্পূর্ণ বন্ধ করার ফতোয়া দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন হলো-
১. 'মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে স্বর্ণ। এই জন্য বাজারে স্বর্ণের মধ্যেই ভেজাল বেশী। তাই ভেজালের কারণে কি কেউ স্বর্ণের দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেবে?
২. ধরুন কম্বলে ছারপোকা হয়েছে এজন্য কি কম্বলটাই জ্বালিয়ে দেব? নাকি ছারপোকা বাছাই করে কম্বলের হেফাজত করবে?
উত্তর হবে- 'স্বর্ণের হিফাজত আর কম্বলের হেফাজত অবশ্যই জরুরী।'
তেমনি সত্যিকার তাছাউফের সাধনা করা এবং শরীয়ত সম্মত সঠিক তরীকতের অনুসরণ করা জরুরী। সাহাবায়ে কেরাম কেবলমাত্র কোরআন পড়ে নিজেদের বাতেনী চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে নবী করীম (সা.) থেকে সবকিছু জিজ্ঞেস করতেন। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
"আল্লাহ্তা’লা নবী করীম (সা.) কে রিসালতের দায়িত্ব দিয়ে তাদের নিকট মনোনীত করে প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ্তা’লার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে তাদেরকে শুনান, তাদের জীবনের জাহেরী, বাতেনী উভয় দিকের পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের তালীম দেন এবং কিতাবের আহকাম বুঝার ও বাস্তবায়িত করার জ্ঞান ও নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষা দেন।"
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআন শিক্ষা এক কথা, আমল করে পরিশুদ্ধি লাভ করা ভিন্ন কথা।
চট্টগ্রামের বিখ্যাস হকপন্থী দরবার বায়তুশ শরফের মহান পীর মুর্শিদ হযরত শাহ্ সূফী মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহ.) বলেছেন- "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলা এক কথা, ইহা শুনা অন্য কথা এবং জাতে পাকের মুহাববতে নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।" শরীরের জাহেরী রোগের চিকিৎসার জন্য যেমন ডাক্তারের প্রয়োজন, তেমনি ক্বলব ও নফসের গোপনীয় রোগ সমূহ যেগুলো মারাত্মক, অতীব সুক্ষ্ম এবং গোপনীয়, চোখে পড়েনা, এগুলোর চিকিৎসার জন্য বাতেনী চিকিৎসক অর্থাৎ পীরে কামেলের অত্যন্ত প্রয়োজন।
মুর্শিদে কামেলের সঙ্গ লাভ করার গুরুত্ব পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত যেমন-
‘‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানুত্তাক্কুল্লাহা ওয়াকুনু মা’আয়াচ্ছাদেকীন।’’
অর্থাৎ- "হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্তা’লাকে ভয় কর এবং আল্লাহর বিশ্বস্ত বন্ধুদের (সাদেকীনদের) সঙ্গ লাভ কর।"
কুরআন শরীফের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
"মুমিনদের মধ্যে এমন কতগুলো লোক রয়েছেন যাঁরা আল্লাহ তা’লার সাথে কৃত অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছেন।"
মুফাসসিরীনে কেরাম উক্ত আয়াত দ্বয়ে ‘সাদেকীন’ অর্থ মোর্শেদে কামেলই নিয়েছেন। আল্লাহ্তা’লা তাঁদের সান্নিধ্য লাভের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
কুরআন শরীফের ইরশাদ হয়েছে-
"যারা সকাল বিকাল আল্লাহ্তা’লার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্তা’লাকে ডাকে (যিকিরে) রত থাকে তাদের সান্নিধ্যে ধৈর্যের সাথে অবস্থান করুন। যাদের ক্বলব আল্লাহ্তা’লার যিকির থেকে গাফিল ও অবহেলিত রয়েছে তাদের অনুসরণ কর না। যারা দ্বীনি এলম বা জ্ঞান অর্জন করে আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে তাদের পথই অনুসরণ কর।"
উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারা নবী করীম (সা.) কে সম্বোধন করে আল্লাহ্তা’লা উম্মতদেরকে আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যে সকল ব্যক্তি দুনিয়াবী লোভ লালসার লিপ্ত হয়েও শয়তানের প্রলোভনে পড়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বা তাঁর ওয়ারিশগণের সম্পর্ক দুনিয়াতে কায়েম করেনি, তারা হাশরের দিন অনুতপ্ত হয়ে বলবে- আমি কেন রাসূল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করলাম না এবং কেন আমি আল্লাহ্তা’লার নেক বান্দাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করলাম না, এজন্যই আমার আফসোস।
আল্লাহ্তা’লা পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
"দুনিয়াবী স্বার্থ ও লোভের জন্য যারা পরস্পর বন্ধুত্বের সম্পর্ক কায়েম করবে কিয়ামতের দিন তারা পরস্পর একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে।"
অবশ্য যদি ঈমানের স্বার্থে ও দ্বীনি লাভ হাসিল করার উদ্দেশ্যে সে সম্পর্ক আল্লাহ্তা’লার পথের পথিকদের সাথী হবার যাদের নছীব হয়েছে, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্তা’লা নিজেই প্রশংসা করতে গিয়ে এরশাদ করেছেন-
‘‘ঐ সকল লোক তাদের কতই সুন্দর ও উত্তম সাথী।"
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ ফরমান-
‘‘মানুষের ধর্ম তার সহচরের ধর্মের ন্যায়। কোন ব্যক্তির দ্বীনি ভাবধারা কি রকম ইহা জানতে হলে দেখতে হবে যে, সে কি রকম ব্যক্তির সাথে উঠাবসা করে। যদি সে সালেহীন বা মোরশেদের সাথে সম্পর্ক রাখে, তখন সে তাদের মধ্যে গণ্য, যদি সে যাকেরীণদের সাথে উঠাবসা করে, তাহলে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।"
অনূরূপ পবিত্র হাদীসে আরো এরশাদ হয়েছে- ‘‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য। যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে, সে তার সাথী।’’
পবিত্র হাদীসের বাণী দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, যে যাকে ভালবাসে এবং যে যাদের রূপ ধারণ করে বা অনুকরণ ও অনুসরণ করে তাদের সাথে তার হাশর হবে। এতে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি পীর-মশায়েখদের সাথে সম্পর্ক কায়েম করবে এবং তাদের পথে অটল বিশ্বাস রেখে আল্লাহ্তা’লার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যই ধৈর্য্য সহকারে স্বীয় জীবন অতিবাহিত করবে ইহা পরকালে তাদের নাজাতের ওসীলা হবে, বেহেশতে তারা একই সাথে থাকবে এবং আল্লাহ্তা’লার দীদার ও দর্শন লাভে ধন্য হবে।
আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী (রাহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী শরীফে আল্লাহ্তা’লার মাহবুব বান্দাদের জাহেরী সুরত অনুকরণ যে আল্লাহ্তা’লার কাছে পছন্দনীয় এবং উহা নাজাতের ওসীলা হতে পারে, এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
"হযরত মূসা (আ.) এর যামানায় একজন বহুরূপী ছিল, যে হযরত মূসা (আ.) এর বেশ গ্রহণ করে তামাসা দেখাত সেও হযরত মূসা (আ.)-এর পোষাকের জাহেরী অনুকরণের দ্বারা ফেরাউনের সৈন্যদের সাথে থেকেও মুক্তি পেয়েছিল যেমন- মাওলানা রুমী (রা.) বলেন- আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের জাহেরী পোষাক পরিধান করা সেটাও আল্লাহ্তা’লার কাছে প্রিয়। ঐ সকল বান্দাদেরকে কিভাবে আল্লাহ্তা’লা ডুবিয়ে মারবেন, যারা আল্লাহ্তা’লার দয়ার পাত্র!
উপরোল্লিখিত এলমে তাছাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং জাহেরী বাতেনী এলম একসাথে যাঁরা লাভ করেছেন তাঁরাই মোরশেদে কামেল। তাঁদেরই সান্নিধ্যে বা সংশ্রবে থেকে নিজ জীবনের বিভিন্ন রোগ হতে মুক্ত হওয়া এবং তাঁদের অনুকরণ ও অনুসরণে বাতেনী জ্ঞানের অবগতি লাভ করা হয়। শুধু জাহেরী এলম দ্বারা পবিত্র কুরআনের তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করা সম্ভবপর নহে। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্তা’লা হযরত মুসা (আ.) ও খিযির (আ.) ঘটনা পবিত্র কোরআন শরীফে বর্ণনা করেছেন। কোরআনের উক্ত ব্যাখ্যায় মুফাচ্ছেরীনগণ বলেন- হযরত ইবনে আববাস (রা.) নবী করীম (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন।
"একদিন হযরত মূসা (আ.) বনী-ইসরাইলের মধ্যে ওয়াজ করছিলেন, ওয়াজে মুগ্ধ হয়ে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাস করলেন- আপনার চাইতে বড় আলেম আর কেউ আছে কি? তিনি উত্তরে বললেন- সব চাইতে বড় আলেম বর্তমানে আমি নিজেকে মনে করি। হযরত মূসা (আ.) এই দ্বীনি এলমের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করা ঠিক ছিল, কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ্তা’লার একজন নবী, তাই নবীর থেকে বড় আলেম আর-কে হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ্তা’লার প্রতি ন্যস্ত (আল্লাহ্ই ভাল জানেন একথা) না করাতে আল্লাহ্তা’লা মূসা (আ.) এর নিকট ওহী পাঠালেন- হে মূসা আমার এক বিশিষ্ট বান্দা আছেন, যিনি তোমার চাইতে অধিক এলম রাখেন। মূসা (আ.) আরয করলেন, ইয়া আল্লাহ্! কিরূপে আমি তাঁর সাক্ষাৎ পেতে পারি। উক্ত ঘটনাটি পবিত্র কোরআন শরীফের ১৫ পারার শেষ দিকে ও ষোল পারার শুরুতে আল্লাহ্পাক বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। পবিত্র বুখারী শরীফেও এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
নবী করীম (সা.) উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর ফরমায়েছেন- "হে আল্লাহ্ মূসা (আ.) কে রহম করুন। তিনি ধৈর্য ধারণ করলে ভাল হতো, আরো ঘটনা জানতে পারতাম।"
আমরা উক্ত ঘটনা থেকে এই উপদেশ লাভ করতে পারি যে-
১) জাহেরী ও বেতেনী এলম উভয়ই এক নয়।
২) বিভিন্ন মুফাচ্ছেরীনে কেরাম বলেছেন যে, হযরত খিযির (আ.) একজন আল্লাহর ওলী। আল্লাহ্তা’লা তাঁকে সৃষ্টি রহস্য ও তত্বজ্ঞান দান করেছেন- হযরত মূসা (আ.) যা বুঝতে অক্ষম ছিলেন।
৩) পবিত্র কোরআন শরীফের ইঙ্গিতে বুঝা যায়, বাতেনী বা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিগণের সান্নিধ্য লাভ ও ধর্য্য ধারণ করতে পারলেই জাহেরী ও বাতেনী এলম লাভ করা যায়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব যে, ইসলাম কেবল প্রচলিত অর্থে জিহাদ বা তরবারীর জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং নবী করীম (সা.) এর চরিত্র, মহানুভবতা, দেখেই মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে। অনুরূপভাবে ভারতবর্ষেও ইসলামের প্রচার প্রসার হয়েছে সূফী দরবেশদের দ্বারা। তাঁদের আময়িক ব্যবহার ও সুন্দর চরিত্রের মধ্যেই মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছে। এরপর লাখ লাখ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। কাজেই আউলিয়া কেরামগণ আত্মশুদ্ধির পথ ধরে যে নীরব জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন তাকে অবমূল্যায়ন করা ইতিহাসকে অস্বীকার করার শামিল হবে। কেননা পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে বর্তমানে প্রায় ৫০ কোটি মুসলমান। তা পীর আউলিয়াদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দাওয়াতী কার্যক্রমের ফসল।
আউলিয়ায়ে কেরামের দাওয়াতী কার্যক্রমের মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে পবিত্র কোরআন মজিদ হতে- আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
‘‘আপনি হিকমত এবং উত্তম উপদেশ সহকারে মানুষকে আপনার প্রভুর পথে আহবান করুন।"
কিছু সংখ্যক লোক পীর আউলিয়াদের নীরব জিহাদকে বুঝতে না পারার কারণে সমালোচনা করে। দলের উপর অত্যধিক গুরুত্ব না দিয়ে, আউলিয়ায়ে কেরামগণ ইসলামের প্রচারের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তা যদি অনুসরণ করা হতো তাহলে এত সংঘাত ও হানাহানি হত না। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সহনশীলতার আদর্শকে ভুলে গেছি। তিনি জানের শত্রু কাফেরদের সাথে যে উদারতা দেখিয়েছেন তা আমাদের সম্মুখ থেকে এখন অনেক দূরে। এ অবস্থা দেখে অনেক বিজ্ঞ লোক মন্তব্য করেছেন যে, দলীয় ইসলাম আর নবীর ইসলাম এক নয়।
আমরা জানি ইসলাম এক। কিন্তু এই ইসলামের চার মাজহাব এবং আধ্যাত্মিক লাইনে চার তরীকা ইসলাম সম্মত বলে স্বীকৃত। আল্লাহর কাছে এগুলো মকবুল, তাহলে আমরা কেন শুধু আমার দলই হক ও সত্যের উপর আছে, অন্যরা বাতিল এ ধরনের অহমিকার আশ্রয় নেব। ইসলামের আদেশ নিষেধ ও হুকুম আহকাম রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনকে ইসলামী রাজনীতি বলা হয় কিন্তু সবাই জানেন যে, শুধু আইন কানুন জারি করলে, ইসলাম হয়ে যাবে না। মানুষ যেন অন্তর দিয়ে ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলে তার জন্য মানুষের নৈতিক সংশোধন ও চারিত্রিক উন্নতি বিধান প্রয়োজন। এ কাজটি অত্যন্ত সুন্দর রূপে আঞ্জাম দেন আধ্যাত্মিক সাধক কামিল পীর মুরশিদগণ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মানুষের নফস ও চরিত্র সংশোধনের এ চেষ্টাও জিহাদ হিসাবে গণ্য। বরং হাদীস শরীফের ভাষ্য অনুযায়ী এটাই জিহাদে আকবর শ্রেষ্ঠতম জিহাদ। কারণ কারো চরিত্র সংশোধন, ব্যক্তিত্ব গঠন ও যোগ্যতার বিকাশ না হলে যুদ্ধ বিগ্রহ করে সাময়িক বিজয় লাভ করলেও সে বিজয়কে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বিষয়টি একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সবার কাছেই এর গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে পড়বে।
বুযুর্গানে দ্বীন মানুষের নফসানী রোগ ব্যাধির সংশোধনের জন্যে যে সব খাত বর্ণনা করেছেন তন্মধ্যে একটি হলো যিকির। যিকির মানে আল্লাহ্কে স্মরণ করা। আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিব ইবাদতের পর বিশেষ নিয়মে যিকির করা মোস্তাহাবের মধ্যে গণ্য। ইবাদত বন্দেগীও আত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রে যিকিরের ভূমিকা হলো জমিনে সার দেয়ার ন্যায়। যিকির করা মানে ঈমানের গোড়ায় সার দেয়া। মানুষের গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ক্বলব বা আত্মা। এই আত্মাকে সংশোধন করার কোন প্রক্রিয়া দুনিয়ার কোন জ্ঞানী-মনীষী ও বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি। অথচ এই ক্বলবের ভাল মন্দের উপর সব কিছু নির্ভর করে।
হাদীস শরীফে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন-
‘‘মানব দেহের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে। তা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সমস্ত দেহটাই সুস্থ থাকে। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে পুরো শরীরটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সাবধান! মনে রেখ এটাই হলো ক্বলব।’’
দেহের পরিচর্যার জন্য আমরা ভাত-গোশত বিভিন্ন খাদ্য খেয়ে মুখে পেটে শান্তি পাই। কিন্তু আত্মার শান্তি কোথায়? আল্লাহ্পাক তার জবাব দিয়ে বলেন-
‘‘সাবধান! আল্লাহর যিকিরের দ্বারাই আত্মা প্রশান্তি লাভ করে।’’
পীর বুযুর্গদের শেখানো পন্থায় যিকির করতে করতে যখন যিকির অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তখন সব সময় আল্লাহর কথা স্মরণে আসে। আল্লাহর ভালবাসায় মন তৃপ্ত থাকে। বিশেষতঃ চরম বিপদে আপদে, মৃত্যুর সময়, সাকারাতের সময় আল্লাহর কথা স্মরণে আসে। মূলতঃ যিকিরের দ্বারা মুর্দা ক্বলব জিন্দা হয়ে যায়। যার ক্বলব জিন্দা হয়েছে তার তো মৃত্যু নেই। সে শুধু এজগৎ থেকে পর জগতে ইন্তেকাল করেন। স্থানান্তরিত হন। এ ধরনের যাকেরীন বান্দাই আল্লাহর পরম সান্নিধ্য লাভ করেন।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন- ‘‘যে ব্যক্তি আমার যিকির করে আমি তার সাথী হয়ে যাই।"
আপনারা বলুন জীবনে এর চাইতে বড় সম্পদ আর কি হতে পারে?
পরিশেষে আমি বলব আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি আল্লাহর মাখলুকের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। কেননা আল্লাহর বান্দাদের বিশেষ করে গরীব দুঃখি অসহায়দের খেদমত করার মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। এ জন্যই তরীকত বা আধ্যাত্মিক সাধনার অপর নাম খেদমতে খালক। হযরত শেষ সা’দী (রাহ.) অতি সুন্দর করে বলেছেন-
‘‘তরীকত আধ্যাত্মিক সাধনা আল্লাহর সৃষ্টির সেবা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
তসবীহ, সাজ্জাদা ও ছেঁড়া জামা বহন করার নাম তরীকত নয়।’’