Email:-bdgunman@gmail.com


বৌদ্ধ সাধনা পদ্ধতি ও নিয়মাবলী


বাংলাদেশে বিদর্শন ভাবনা প্রসংঙ্গে কিছু বলতে গেলে বা কিছু লিখতে গেলে যতগুলি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বা পরিচালনা পদ্ধতি প্রসংঙ্গে আলোচনা করে যে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা শুদ্ধ, আদর্শ এবং বুদ্ধ নির্দেশিত পথে হয়ে থাকে তা তুলে ধরা উচিত। কিন্তু এই আলোচনার তা না করে অর্থাৎ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার আলোচনা না করে শুধুমাত্র আদর্শ, শুদ্ধ এবং বুদ্ধের নির্দেশিত পথে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের বিবরণ এবং শুদ্ধ আচরণ কী সেই প্রসংঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে “বোধিপাল আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র” একটি অরাজনৈতিক বৌদ্ধ ধর্ম কল্যাণ ও নির্বাণমুখী এবং বৌদ্ধধর্মীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানমূলক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সংবর্ধিত প্রখ্যাত বিদর্শনাচার্য শ্রী তেমিয় ব্রত বড়ুয়া মহোদয় তাঁর অভিজ্ঞ ধ্যান পরিচালকদের নিয়ে এবং একটি শক্তিশালী কার্য নির্বাহী পরিষদ নিয়ে অতি দক্ষতার সহিত প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছেন। বুদ্ধের সম্যক মার্গের আচরণে এবং আচরণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করাই এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য । বুদ্ধ শিখায় উজ্জিবিত, নির্বাণ পথের পথ প্রদর্শক দুর্লভ কল্যাণমিত্র আন্তর্জাতিকভাবে সংবর্ধিত দার্শনিক ও বিদর্শনাচার্য আর্যশ্রাবক শ্রীমৎ বোধিপাল শ্রমণ মহোদয়ের নামানুসারেই এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। ২০০১ সালে ইহা প্রখ্যাত বিদর্শনাচার্য আন্তর্জাতিকভাবে সংবর্ধিত,আর্যমাতা রানুপ্রভা বড়ুয়ার দাহক্রিয়ার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার আগে ১০৭৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ভ্রম্যমান প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হিসেবে বিভিন্ন স্থান ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ১০ দিনের অস্থায়ী বিদর্শন ভাবনা কোর্স পরিচালনা করে আসছিল। বর্তমান সময়ের মতো এখন এত ধ্যান পরিচালক কিংবা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। শুধুমাত্র আর্যশ্রাবক বোধিপাল শ্রমণ মহোদয়ের পরিচালিত বিদর্শন ভাবনার প্রশংসা এবং প্রচারণা ঢালাওভাবে প্রচারিত হচ্ছিল। বোধিপাল শ্রমণ মহোদয়ের বিদর্শনাচার্য হওয়ার কথা প্রচারিত হবে না কেন? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদর্শনাচার্য ড. রাষ্ট্রপাল মহাথেরো মহোদয় প্রয়াত বোধিপাল শ্রমণ মহোদয়ের মহাপ্রয়াণের পর পেটিকাবদ্ধ অনুষ্ঠানে দেশনার উল্লেখ করেছিলেন বাংলাদেশের গগণ হতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটেছে। এ রকম মহাপুরুষের আবির্ভাব জগতে বিরল। যিনি দর্শন এবং বিদর্শনে পারভূ।
ভারতে একজন ছিলেন তিনিও বিদায় নিয়েছেন। শীলানন্দ ভ্রহ্মচারী মহোদয়। বোধিপাল শ্রমণ মহোদয় গৃহী অবস্থায় থাকতে প্রয়াত সংঘনায়ক দর্শন সাগর শ্রীমৎ প্রিয়ানন্দ মহাথেরো মহোদয়ের নিকট দর্শন শিক্ষা নিয়ে মনোরঞ্জন বড়ুয়া হতে মনোরঞ্জন সাধু নামে খ্যাত হন। একজন মানবের পক্ষে কতবার জন্ম দেয়া সম্ভব সেটি শ্রমণ মহোদয়ের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। উনি মাতা-পিতার ঘরে জন্ম নেওয়ার পর মনোরঞ্জন বড়ৃয়া নাম ধারণ করেন দর্শন সাগর প্রিয়ানন্দ মহোদয়ের কাছে যখন দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন তখন তাঁর নাম মনোরঞ্জন সাধুতে পরিণত হয়। পুনশ্চ আবার ডক্টর রাষ্ট্রপাল মহাথেরো মহোদয়ের নিকট শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর নাম হয় বোধিপাল শ্রমণ। পুনশ্চ আর্যত্ব প্রাপ্তির পর উনি আর্যশ্রাবক হন এবং বিদর্শন ভাবনা শিক্ষা দেয়া শুরু করলে তিনি বিদর্শনাচার্য উপাধিতে ভূষিত হন। এরূপ অমিত গুণসম্পন্ন মহাপুরুণগণের গুণের ব্যাখ্যা সত্যিই অসম্ভবই বটে।
ক্রমে আর্যমাতা রানুপ্রভা বড়ুয়াকে পেয়ে তাঁর পরিচালনার হাত দৃঢ় হয়। তার ও কিছু পরে আর্যপুত্র বর্তমান বিদর্শনাচার্য শ্রী তেমিয়ব্রত বড়ুয়া মহোদয়কে পেয়ে তাঁর পরিচালনার হাত আরও সুদৃর ও সম্প্রসারিত হয়। এই তিনজন বিদর্শনাচার্য মহোদয়গণের মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশ বৌদ্ধদের জন্য সত্যিই পরম প্রাপ্তি এবং পুণ্যময় অধ্যায়। কিন্তু কর্মের কি নিষ্ঠুর গতি এই ধারা যখন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অবিরাম গতিতে চলে আসছিল ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ১৪ই এপ্রিল আর্যমাতা রানুপ্রভা বড়ুয়ার মহাপ্রয়াণ ঘটলো। আর্যমাতা ছিলেন বর্তমান প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সব সময়ই পৌর এলাকায় (চট্টগ্রাম শহরের) বৌদ্ধ অধ্যষিত অঞ্চলে একটি স্থায়ী বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সর্বশক্তি নিবেদন করে গেছেন। তাই ২০০১ সালে তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁরই দাহক্রিয়ার স্থানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে অত্র প্রতিষ্ঠান। আর্যমাতা অন্তর্ধানে আর্যশ্রাবক বোধিপাল শ্রমণ মহোদয় বর্তমানে বিদর্শনাচার্ আর্য পুদগল শ্রী তেমিয়ব্রত বড়ুয়ার পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিষ্ঠানের ভিতরে এবং ভ্রম্যমাণ শিবির গুলিতে বিদর্শনা ভাবনা পরিচালনা পূর্ণ উদ্যেমে চলতে থাকে এবং বর্তমানে ভ্রম্যমাণ শিবির পরিচালনার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। কিন্তু আয়ু সংস্কারের কারণে ২০০৩ সালে আর্যশ্রাবক শ্রীমৎ বোধিপাল শ্রামণ মহোদয়ের মহাপ্রয়াণ ঘটলো। চট্টগ্রাম তথা ভারত বাংলার বহু গুণগ্রহী চরম শূণ্যতা অনুভব করল অধ্যত্মিক সাধনা জগতে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বর্তমানে বিদর্শন আচার্য পরম কল্যাণমিত্র শ্রী তেমিয়ব্রত বড়ুয়া মহোদয় অত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য সহযোগিতার সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারা পরিচালনায় সফলতা বজায় রেখেছেন।
এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বৎসরের প্রতিদিন বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন প্রশিক্ষণ চলে। আবার ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বিভিন্ন গ্রামের বিহারে/ প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করা হয়। ইহা ছাড়া বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের গবেষণামূলক আলোচনা (সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত) অনুষ্ঠিত হয়। তা আবার ভ্রাম্যমাণ হিসেবেও বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেমিনার পরিচালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে বিদর্শনাচার্য মহোদয়ের পরিচালনায় কেন্দ্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমা তিথি ধর্মীয় মর্যাদায় উদযাপিত হয়ে থাকে। এ সকল উন্নয়নমুখী কার্যক্রম বার্ষিক মুখপত্র “বোধি” এর মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে গরীব বৌদ্ধদের জন্য বিনা খরচায় বিদর্শন ভাবনা আচরণ করার সু ব্যবস্থ্য বিরাজমান। তাছাড়া কেন্দ্রের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে বিশেষ ফ্রি বিদর্শন ভাবনা কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন চান্দগাঁও এলাকাবাসীর জন্য ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস সময়ে; ডিসেম্বর মাসে (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ছুটির সময়ে) শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য “বিশেষ ফ্রি বিদর্শন ভাবনা কোর্স; দাতা সদস্যদের জন্য এবং ভিক্ষু শ্রামণদের জন্য বিশেষ ফ্রি বিদর্শন ভাবনা কোর্স এর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এ সমস্ত কর্মকান্ডে অনেকে আর্থিক, কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে সাহায্য প্রদান করে জীবন ধন্য করার প্রয়াস পাচ্ছেন। এ সব কিছু পরিচালনা ও পরিবেশনে পরিপূর্ণ ভূমিকা পালণ করছেন বর্তমান বিদর্শন আচার্য মহোদয়। তিনি এসকল কাজে ফাঁকে ফাঁকে সমাজের সর্ব সাধারণের জন্য ধর্মীয় পুস্তকও প্রণয়ন করে চলেছেন। পুস্তকগুলি জ্ঞানী মহলে প্রশংসার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। কেননা পুস্তকগুলি বেশীরভাগ বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের উপর প্রকাশিত। তাই তিনি প্রায় সময় বলে থাকেন এ পুস্তকগুলিতে যদি কোন ভ্রান্তি প্রকাশিত হয় তবে তা দর্শনের আকারে ধরা পড়বে। তারপরও যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় জানালে তা সংশোধনের ব্যবস্থা নেবেন। অত্র ভাবনা কেন্দ্রের প্রায় প্রচার পত্রে শুদ্ধাশুদ্ধ যাচাই বাছাই করার জন্য একটি “বিশেষ বিজ্ঞাপ্তি বা বিশেষ দ্রষ্টব্য” শিরোনামে প্রকাশ করার সুযোগ দিয়ে আসছেন, সে সুযোগ লিখিতভাবে প্রচার করা হয়। ভ্রাম্যমাণ বিদর্শন ভাবনা কোর্স সমূহে সমাপনীর আগের দিন প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন থাকে। এছাড়া প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার বেলা ২:৩০ মিনিট দর্শনে গবেষণামূলক অনুষ্ঠানে ধর্ম দর্শনের উপর প্রশ্ন করে জানা যায় বিবিধ অজ্ঞাত বিষয় ‍যা সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। অথচ এ রকম ব্যবস্থা কোন প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত নেই।
সমাজে অনেকে নিজেকে পন্ডিত বলে মনে করেন। তাঁরা বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বা গবেষণা করে তাঁদের পন্ডিত বলে ধারণা আসতে পারে। কিন্তু বুদ্ধের সেই আসল গবেষণায় পৌঁছতে হলে বা আসল পন্ডিত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই ব্যবহারিক জ্ঞান সহ শাস্ত্র জ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে। তাহলেই তিনি পন্ডিত হতে পারবেন। বিদর্শন ভাবনা সঠিক আচার্যের মাধ্যমে শুদ্ধ আচরণ করলে তাঁর প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন হবে। প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন হরে সংস্কার নিরোধ হবে। সংস্কার নিরোধ হলে নামরূপ পরিচ্ছদ জ্ঞান ও উদয় ব্যয় জ্ঞান ইত্যাদি ষোল প্রকার জ্ঞান উৎপন্ন সহ মার্গ পথে পদার্পণ করবেন। এ বিষয়ে পরিপূণূ জ্ঞান অর্থাৎ বিদর্শন ভাবনা শুদ্ধ আচরনের মাধ্যমে মার্গ পথে বিচরণ না করে অন্য বিদর্শনাচার্যের পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করলে উপবাদ অন্তরায় হতে পারে। তাই বিদর্শন জ্ঞানের নীতি সোপান তথা নির্বাণ পথের জ্ঞান হয় একমাত্র বিদর্শন ভাবনা আচরণের মাধ্যমে, শাস্ত্র গবেষণার নয়। এ প্রসংঙ্গে এখানে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যাক-
শ্রাবস্তীর দুই বন্ধু তথাগত বুদ্ধের উপদেশ শুনে ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করেন। পাঁচ বৎসরকাল গুরুর নিকট অবস্থান করে বিবিধ কর্তব্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে একজন উপদিষ্ট শিক্ষায় সাধনায় সিদ্ধি লাভ করলেন। অপরজন ত্রিপিটক অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা কাজে নিযুক্ত রইলেন। চরম বিমুক্তি তাঁর অধিগত হল না বুদ্ধ এ বিষয়ে অবগত হয়ে পান্ডিত্য অপেক্ষা আচরনই বিশেষ ফলপ্রদ বলে নিম্মের গাথাদ্বয় আবৃত্তি করলেন-
“বাহুম্পি সে সহিতং ভাসমানো ন তক্করো হোতি নরো পমত্তো,
গোপো বা গাবো গমাং পায়েসং ন ভাগবা সামঞ্ঞস্স হোতি।”
-বহু শাস্ত্র জ্ঞান যার বহু অধ্যয়ন, অথচ সে শাস্ত্র মতে চলে না কখন।
শ্রামণ্য ফলের ভাগী হয় না সেজন, গোপ (রাখাল) যথা পর গাভী লাভেনা কখন।”
অপ্পম্পিচে সহিতং ভাসমানো, ধম্মস্স হোতি অনুধম্মচারি,
রাগঞ্চ দোসঞ্চ পবায মোহং সম্মপ্পজানো সুবিমুত্ত চিত্তো,
অনুপাদিসনো ইধ বা হুরং বা, স ভাগবা সামঞ্ঞস্স হোতি।
-অল্প শাস্ত্র জানে কিন্তু শাস্ত্রের মতন, পালে ধর্ম রাগ, দ্বেষ মোহ হীন জন।
সম্পজ্ঞানী মুক্তচিত্ত উপাদান ত্যাগী, উভলোক হন তিনি শ্রামণের ভাগী।
যে প্রমত্ত ব্যক্তি ধর্মচার্যের নিকট বহুল পরিমাণ বুদ্ধের ধর্ম অধ্যয়ন করেও যথাযথ আচরণে বিরত থাকেন, সে ব্যক্তি রাখালের সহিত তুলনীয় হন। অর্থাৎ রাখাল যখন সারাদিন গরুর সেবা যত্ন করেও গব্যরসের অধিকারী হতে সমর্থ হয় না, সেরূপ বুদ্ধ বচন প্রচুর আবৃত্তি করলেও সেই ধর্মের রস পানের অধিকারী হতে পারে না। অপর পক্ষে অপ্রমত্তভাবে যিনি অল্প পরিমাণেও বুদ্ধের বাণী অধ্যয়ন করেন, তারা সুন্দর রূপে আচরণ করেন, নব লোকোত্তর ধর্মের অনুকূল ধর্মার্থ অবগত হয়ে কাম প্রবৃত্তি দমন করেন এবং মনে প্রাণে মুক্তি অভিসরী হন, তিনিই বিদর্শন ভাবনা বলে কাম-দ্বেষ-মোহকে সর্বতোভাবে পরাভূত করে মুক্তি পারের সন্ধান লাভ করেন এবং কাম, দৃষ্টি, শীলব্রত ও আত্মবাদ ভেদের চারিটি উপাদান সমূলে উৎপাদিত করে অরহত্ব ফল লাভের পর ভববন্ধন মুক্ত হন। তখন তিনি ইহাকল ও পরকালের শ্রামণের ভাগী হতে পারেন। ধর্মের সত্যিকারের দায়ক নির্বাণ লাভী এবং ধর্মের ধারক ও বাহক হতে পারেন।
ভগবান বুদ্ধ অনেক গবেষণা করে নির্বাণ লাভের জন্য একটি পথই আবিষ্কার করে গেছেন আমাদের জন্য দুটি পথ নয়। আর সে পথ হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথে আচরণ এবং এ পথে আচরণে মুক্তি লাভ সম্ভব। অন্যভাবে আচরণ বৃথা হবে, বুদ্ধের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যায় বা উপদেশে শুধু বিমুক্তিই উদ্দেশ্যেই ভাবিত ও দেশিত হয়েছে। তাই ইহাকে মহা সমুদ্রের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ মহাসমুদ্রের জল যেখান থেকেই নেওয়া হোক না কেন সবখানেই লোনা। তদ্রুপ বুদ্ধের ধর্ম দর্শন সবখানেই বিমুক্তি রসে পরিপূর্ণ। বুদ্ধ বলেছেন-
মগ্গষ্ঠাঙ্গিকো সটটেঠা, সচ্চানং চতুরাপদা,
বিরাগো সেটঠ ধর্মানং দ্বি পদানঞ্চ চক্ষুমা।
এসোব মগগো নত্থঞ্ঞ, দস্সনস্স বিসুদ্ধিযা
এতঞহি তুমেহ পটিপজ্জথ মারসসেতং পমোহনং।
মার্গমাঝে অষ্টাঙ্গিক, সত্য মাঝে সত্য চতুষ্টয়,
ধর্মেতে বিরাগ শ্রেষ্ট চক্ষুমান মানবে নিশ্চয়।
এ মার্গ বিনা অন্য কোন মার্গ নাই,
দর্শন শুদ্ধির তবে করতে যাচাই।
তাই এ আষ্টমার্গ সবে অনুস্মর,
এ মার্গে মার রাজ্যে সম্মোহিতে পার।
একবার বুদ্ধ ভগবান ভিক্ষু সংঘে কিছুদিন জনপদ ভ্রমণ করে পুররায় জেতবনে ফিরে এসেছেন। একদিন বুদ্ধের সঙ্গে ভ্রমণকারী সে ভিক্ষুগণ অতিথি শালায় গিয়ে তাঁদের ভ্রমণ পথের সুগমতা ও দুর্গমতা সম্বন্ধে আলোচনা করছেন। বুদ্ধ তাঁদের আলোচনা শুনে লৌকিক পথ সম্বন্ধে চিন্তা না করে আধ্যাত্মিক সাধনায় রত হয়ে আর্য মার্গের সন্ধান করতে উপদেশ দিলেন। মুক্তি লাভের জন্য যদিও অনেকে মনে করেন বিবিধ প্রকার পথের নির্দেশ আছে। আসলেই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই একমাত্র পথ।
চক্রবালের বা একত্রিশ লোকভূমির প্রাণীগণ সর্বদা মুক্তি লাভের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করে, অথচ সমস্ত কাজ মুক্তির নয়। কিছু পাপ, কিছু পুণ্য ও কিছু পরমার্থ কাজ। তন্মধ্যে পাপ কাজ ও পুণ্য কাজ বিপাক সৃষ্টি করে। কিন্তু পরমার্থ কাজের বিপাক সৃষ্টি হয় না। অধিকন্তু পরমার্থ কাজের দ্বারা জমাকৃত বিপাক কায়দ্বারে, বাক্যদ্বারে ও মনদ্বারে নিরোধ হয়। এটাই হলো বিদর্শন ভাবনা।
পাপ কাজের কর্মপথ দশটি। যেমন হত্যা, চুরি, মিথ্যা বাক্য, পিশুন বাক্য, (ভেদ বাক্য) পরুষ (কর্কশ) বাক্য, সম্প্রলাপ (অর্থহীন) বাক্য, অভিদ্যা (লোভ), ব্যাপাদ (দ্বেষ) ও ভ্রান্ত ধারণা (মিথ্যা দৃষ্টি)। এ সমস্ত কর্মপথে কাজ করলে জন্মে জন্মে চারি অপায় গমন, যেমন-তির্যক , প্রেত, অসুর ও নিরয় কুলে উৎপন্ন হয়ে অসীম দুঃখ ভোগ করতে হয়। আবার পুণ্য কাজের কর্মপথ দশটি। যেমন- দান, শীল, ভাবনা (শমথ), সেবা, সম্মান, পুণ্যদান, পুণ্যদানানুমোদন, ধর্মশ্রবণ, ধর্মদেশনা ও দৃষ্টি ঋজু কর্ম (সত্য পথ আচরণ) এ সমস্ত কর্ম পথে কাজ করলে মৃত্যুর পর সুগতি লাভ হয়। যেমন মানুষ স্বর্গ ও ব্রহ্মলোকে জন্ম প্রতিসন্ধি গ্রহণ করে সুখ লাভ করে। পাপ কর্মর্জিত দুঃখ এবং পুণ্যকর্মার্জিত দুঃখ উভয়ই অস্থায়ী। এ গুলো ভোগের পর পুনঃ প্রতিসন্ধি বা জন্ম নিতে হয়। আর জন্ম দুঃখ বলে বুদ্ধ আখ্যায়িত করেছেন। ২৫৯৭ বৎসরের মধ্যে একটি মাত্র জ্ঞানী বা ‍বুদ্ধ যিনি জীব জগতের এ দুঃখ অবলোকন করে তাহা নিরোধের জন্য মার্গ বা পথ আবিষ্কার করেছেন। তাহাই বিদর্শন ভাবনা। সে বিদর্শন ভাবনা আচরণ ক্ষেত্রে অনেকের ধারণা শমথ ভাবনা আগে করতে হবে, না হয়তো বিদর্শন ভাবনা লাভ হবে না। আবার অনেকে শমথ ভাবনা করে সরাসরি নির্বাণ লাভ হবে বলে মনে করেন, আবার অনেকে শমথ বা বিদর্শন যে কোন ভাবনা করলে নির্বাণ লাভ হবে বলে মনে করেন। এখন সে আলোচনায় আসা যাক-
“চানমার য়ৈকত ভাবনা কেন্দ্র” ইয়াঙ্গুন, মায়ানমার-এর অধ্যক্ষ সেয়াদ উ জনকাভিংসো বর্ণনা করেছেন, একবার বুদ্ধ উত্তরীয় নামক রুগ্ন ভিক্ষুকে বলেছেন “আরম্ভ যদি বিশুদ্ধ হয় হবে সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বাণ সাক্ষাৎ হবে।”
তাই বুদ্ধের এ একটি বাক্য থেকে বুঝা যায় বিদর্শন ভাবনার যদি মুক্তির একমাত্র পথ হয় তাহলে আরম্ভ শমথ ভাবনা দিয়ে করলে বিশুদ্ধভাবে আরম্ভ হলো কি? মুক্তি মার্গ বা নির্বাণ লাভ হবে কি? আবার যারা শমথ ভাবনার মাধ্যমে শুরু করে মুক্তি পেতে চান, তাঁদের জন্যও সে সময় অতীত হয়ে গেছে। অর্থাৎ পটিসম্ভিদা মার্গসহ অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর এক হাজার বৎসর পার হয়ে ২৫৫২ বৎসরে পৌঁছেছে। কাজের বুদ্ধের বিভিন্ন সময়ের উক্তি থেকে জানা যায় সরাসরি শমথ ভাবনা করেও নির্বাণ লাভ সম্ভব নয় এবং প্রথমে শমথ দিয়ে আরম্ভ করে পুনঃ বিদর্শনে আসা দুরুহ ব্যাপার। সে আলোচনার পরে আসা যাবে।
কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করার পর মহর্ষি ভার্গব- এর আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বিস্তীর্ণ বনরাজি, বিভিন্ন গাছগাছড়ার ভরা এ আশ্রম। সুনিবিড় এ একান্ত তপোবনে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন রকম শারীরিক অবস্থায় বেশ কয়েকজন অসাধারণ কষ্টে কৃচ্ছ সাধনায় ব্রত। তিনি ঘুরে ফিরে দেখলেন, কয়েক রাত অবস্থান করলেন এবং বুঝতে পারলেন এ সমস্ত আচরণে মনুষ্যে জন্মে বা স্বর্গে জন্ম গ্রহণ করা যায়। কিন্তু পুনরায় অপায়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়নি। কাজেই ইহা আচরণে দুঃখ মুক্তি স্থায়ীভাবে হচ্ছে না জেনে ঐ আশ্রম ত্যাগ করলেন। ঘুরে ঘুরে তিনি ঋষি আরাড় কালামের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। আশ্রম প্রধানের সাথে আলোচনা করে জানতে চাইলেন জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, শোক, সংক্লেশ ইত্যাদি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার স্থায়ী কোন পথ আছে কিনা। ঋষি তাঁকে সমস্ত আশ্রম ঘুরে ঘুরে দেখালেন, বুঝালেন এবং আচরণ করতে বললেন। কুমার সিদ্ধার্থ এখানে আচরণে প্রবৃত্ত হয়ে সব চাইতে উন্নততর ব্রহ্মলোকের আকিঞ্চানায়তন ধ্যান লাভ করলেন। এ আকিঞ্চানায়তন থেকে চ্যুত হয়ে পুনরায় কর্মপ্রবাহে প্রতিসন্ধি হবে তাই তিনি তাঁর এ লদ্ধ ধর্ম জ্ঞানে তৃপ্তি লাভ করতে পারলেন না। কেননা ইহা জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর অতীত কোন অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে না মানুষকে। তিনি বুঝতে পারলেন এ ধর্ম নির্বেদের অভিমুখে, বিরাগের অভিমুখে, নিরোধের অভিমুখে, উপশমের অভিমুখে, অভিজ্ঞাতার অভিমুখে, সম্বোধির অভিমুখে, নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয় না। তাই তিনি অনাসক্তভাবে আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ক্রমে তিনি কোশল রাজ্যের রাজধানী শ্রাবস্তীতে এসে পড়লেন। সেখানে ঋষি রামপুত্র রুদ্রকের কথা জানতে পেরে তাঁর আশ্রমে উপস্থিত হলেন এ আশ্রমে যা কিছু কর্মকান্ড আছে সবই তিনি ধীরে ধীরে আয়ত্ব করে নিলেন। তারপর ঋষির নিকট জিজ্ঞাসা করেলেন আর আছে কিনা। ঋষি বললেন এর অধিক কিছু নেই। এখানে সব চাইতে বেশী কিছু লাভ হল একত্রিশ লোকভূমির সর্বোপরি স্থান, আনেঞ্জা সংস্কার, ৮৪ হাজার কল্পকাল সুখ ভোগকারী আরূপ ব্রহ্মলোকের “নৈবসংজ্ঞানাসজ্ঞায়তন”। তার উপরে অধিক সুখ ভোখকারী অন্যা কোন স্থান চক্রবালে আর নেই। অথচ সে অরূপব্রহ্মলোক থেকে চ্যুত হয়ে আবরও অপায়ে প্রতিসন্ধি যোগ আছে। এখন রাজ কুমার সিদ্ধার্থ জানতে পারলেন যে, এখানে (নৈবসংজ্ঞানাসজ্ঞায়তন) ও উপধি নির্মূল হয় না, তা যতই সুক্ষ্ণ হোক না কেন উপধি থাকলেই তা জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর অধীন হবে। সুতরাং এ ধর্ম নির্বেদের অভিমুখে, বিরাগের অভিমুখে, নিরোধের অভিমুখে, উপশমের অভিমুখে, অভিজ্ঞাতার অভিমুখে, সম্বোধির অভিমুখে, নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয় না। কাজেই এখানে থেকেই কোন লাভ নেই। তাই তিনি রামপুত্র রুদ্রকের আশ্রম থেকে বেড়িয়ে পড়লেন নির্বাণ লাভের পথ অম্বেষণে।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ শমথ ভাবনা আচরণ করে বুঝতে পারলেন যে, এ সমস্ত আচরণে নিজেকে নিয়োজিত রাখলে জন্মতা বিফলে যাবে। কৃচ্ছ সাধন ও শমথ ভাবনা আচরণে নিজের শরীর এবং সময় নষ্ট হয়ে গেল অনুভব করে আসল দুঃখ মুক্তির পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। এখানে শমথ ভাবনা কি এবং তার আচরণটা কি রকম তা একটু আলোচনা করা যাক।
শমথ ভাবনা চল্লিশ প্রকার, যথা, দশ প্রকার কৃৎস্ন, দশ অশুভ, দশ অনুস্মৃতি, চারি অপ্রমেয়, এক সংজ্ঞা, এক ব্যবস্থান এবং চারি অরূপ ধ্যান স্তর।
দশ কৃৎস্ন- পৃথিবী কৃৎস্ন, আপ কৃৎস্ন, তেজ কৃৎস্ন, বায়ু কৃৎস্ন, নীল কৃৎস্ন, পীত কৃৎস্ন, লোহিত কৃৎস্ন, অবদাত কৃৎস্ন, আকাশ কৃৎস্নও আলোক কৃৎস্ন।
দশ অশুভ- উদ্ধস্ফীত, বিনীলক, পূঁজপূর্ণ, ছিদ্রীকৃত, বিখাদিত, বিক্ষিপ্ত, কর্তিত-বিক্ষিপ্ত, রক্তাক্ত, কীটপূর্ণ ও অস্তিপূঞ্জ।
দশ অনুস্মৃতি- বৃদ্ধানুস্মৃতি, ধর্ম্মানুস্মৃতি, সংঘানুস্মৃতি, শীলানুস্মৃতি, ত্যাগানুস্মৃতি, দেবতানুস্মৃতি, উপশমানুস্মৃতি, মরনানুস্মৃতি, কায়গতানুস্মৃতি ও আনাপান স্মৃতি (শ্বাস প্রশ্বাস)।
চারি অপ্রমেয়- মৈত্রী, করুণা, মুদিতাও উপেক্ষা।
এক সংজ্ঞা- ভক্ষ্য দ্রব্যের ঘৃণাকর পরিণতি সম্বন্ধে জ্ঞান।
এক ব্যবস্থান- দেহস্থ কঠিন, তরল, উষ্ণ ও বায়বীয় সম্বন্ধে জ্ঞান ও অশুচি ভাবনা।
চারি অরূপ- আকাশানান্তায়তন, বিজ্ঞানান্তয়াতন, অকিঞ্চানায়তন ও নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তন।
এরূপে চল্লিশ প্রকার শমথ ভাবনার চল্লিশটি কর্ম্মস্থান। চল্লিশটি কর্ম্মস্থানের মধ্যে চরিত ভেদে বিভিন্ন কর্ম্মস্থানের উপযোগিত বিদ্যমান। যেমন-
() রাগ চরিত পক্ষে- দশ অশুভ ও কায়গতানুস্মৃতি নামক কোষ্ঠাংশ ভাবনা।
() দ্বেষ চরিতের পক্ষে- নীলাদি চারিবর্ণ, কৃৎস্ন এবং চারি অপ্রমেয়।
() মোহ চরিত ও বিতর্ক চরিতের পক্ষে- আনাপান স্মৃতি।
() শ্রদ্ধা চরিতের পক্ষে- বুদ্ধানুস্মৃতি ইত্যাদি ছয় অনুস্মৃতি।
() বুদ্ধি চরিতের পক্ষে- মরনানু, উপশমানু, সংজ্ঞা, ব্যবস্থানাদি অনুকুল ভাবনা।
() মোহ চরিত ও ক্ষুদ্রাকার বিতর্ক চরিতের পক্ষে- কৃৎস্ন মন্ডলের নির্বাচনে পৃথুল (স্থুল) উপযোগী।
অবশিষ্ট কর্ম্মস্থান সকলের পক্ষে উপযোগী।
চল্লিশটি কর্ম্মস্থানে পরিকর্ম ভাবনা লাভ করা যায়। বৃদ্ধানুস্মৃতি, ধর্ম্মানুস্মৃতি, সংঘানুস্মৃতি, শীলানুস্মৃতি, ত্যাগানুস্মৃতি, দেবতানুস্মৃতি, উপশমানুস্মৃতি, মরনানুস্মৃতি, আহার অশুভ সংজ্ঞা এবং ধাতু ব্যবস্থান এই দশটি কর্মস্থানে উপাচার ভাবনা লাভ করা যায়। অবশিষ্ট ত্রিংশ কর্মস্থানে অর্পনা ভাবনা লাভ করা যায়।
আবার দশ অশুভ ও কায়গতানুস্মৃতি ভাবনা দ্বারা প্রথম ধ্যান লাভ হয়।
মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ভাবনা দ্বারা চতুর্থ ধ্যান লাভ হয়।
দশ কৃৎস্ন, আনাপান ও উপেক্ষা ভাবনা দ্বারা পঞ্চম ধ্যান লাভ হয়।
চারি অরূপ ধ্যান ও দশ উপাচার ধ্যান ব্যতীত বাকী ছাব্বিশটি কর্মস্থান রূপলোকের ধ্যান উৎপন্ন করে। এ সমস্ত গুলি শমথ ধ্যানের লাভ, নিবৃত্তি বা নির্বাণের লাভ এতে নেই।
যদি কেহ শমথ ভাবনার মাধ্যমে শুরু করে নির্বাণ লাভ করতে চেষ্টা করেন তবে উপরোক্ত ত্রিংশ কর্মস্থানের যে কোন একটা কর্মস্থানে ভাবনার দ্বারা প্রথম থেকে পঞ্চম ধ্যানিক কর্মস্থানের কাজ সমাপনান্তে পুনরায় বিদর্শন ভাবনার নিমজ্জিত হও। ভাবনার দ্বারা হয়ত অরহত নয়তোবা অনাগামী লাভ হয়। যার নাম প্রতিসম্ভিদা মার্গ যা বর্তমানে লাভ সম্ভব নয়। প্রতিসম্ভিদা জ্ঞান লাভ হয় বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর এক হাজার (১০০০) বৎসর পর্যন্ত। বর্তমানে বুদ্ধের পরিনির্বাণ হয়েছে আড়াই হাজার (২৫০০) বৎসর অতীত হয়ে গেছে। সে হিসেবে বুদ্ধের নিয়মে তৃষ্ণা ক্ষয় করে মার্গফল লাভ করার যথেষ্ট সুযোগ বিদ্যমান।
ভগবান বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথম বারাণসীর নিকটবর্তী ঋষিপতন মৃগদাবে পঞ্চ বর্গীয় শিষ্য কৌন্ডিণ্য , বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অশ্বজিতকে উপদেশ সহকারে দেশনার বলেছিলেন,হে ভিক্ষুগণ নির্বাণকামী ব্রতচারী দুই অন্তের অনুশীলন করবে না, প্রথম কাজে কম সুখোদ্রেকের প্রতি অনুরক্তি, যা হীন, গ্রাম্য, ইতর সাধারণের সেবা, অনার্য জনোচিত ও অনর্থকর, দ্বিতীয়/ আত্ম নিগ্রহে অনুরক্তি যা দুঃখ দায়ক, নিকৃষ্ট ও অনর্থকর। এ দুই অন্ত বর্জন করে তথাগত মধ্যম প্রতিপদ বা মধ্যমপন্থা, অভিসম্ভোদি জ্ঞান লাভ করেছেন যা চক্ষুকরনী ও জ্ঞান করনী এবং যা উপশমা অভিজ্ঞ, সম্ভোদি ও নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গিই সে মধ্যম প্রতিপদ। যথা সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।
এ দেশনার পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের মধ্যে কৌন্ডিণ্য ধর্ম চক্ষু লাভ করেন। অর্থাৎ মার্গফল লাভ করেন, জগতে প্রথম স্রোতাপন্ন মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সে দেশনায় আঠার কোটি দেব, ব্রহ্মা ধর্ম চক্ষু লাভ করেন। মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাতে অন্য কিছুই প্রয়োজন হয়নি। এখনও এরকম মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। আবার অন্তিম সময়ে অর্থাৎ বুদ্ধের পরিনির্বাণের সময় কুশীনগরে মল্লদের শালবনে পরিব্রাজক সুভদ্রকে বললেন, হে সুভদ্র! যে ধর্ম বিনয়ে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গেই উপলদ্ধি নেই (আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ নেই) প্রথম শ্রমণও তথায় নেই, দ্বিতীয় শ্রেণীর শ্রমণও তথায় নেই, তৃতীয় শ্রেণীর শ্রমণও তথায় নেই, চতুর্থ শ্রেণীর শ্রমণও তথায় নেই, এবং থাকতে পারেনা। সুভদ্র! যে ধর্ম বিনয়ে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপলদ্ধি আছে, (আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আছে) প্রথম শ্রমণও তথায় আছে, তথায় দ্বিতীয় শ্রেণীর শ্রমণও আছে, তৃতীয় শ্রেণীর শ্রমণও আছে, চতুর্থ শ্রেণীর শ্রমণও আছে। হে সুভদ্র! ঊনত্রিশ বৎসর বয়সে আমি সর্বজ্ঞাতা জ্ঞান লাভ করার জন্য প্রব্রজিত হয়েছিলাম। যখন আমি প্রব্রজিত হই, সেদিন হতে এখন পর্যন্ত ৫১ বৎসর পর্যন্ত আমি আর্য মার্গ ধর্মের প্রদেশে বিদর্শন মার্গ প্রবর্তন করেছি। ইহার মধ্যে প্রথম শ্রমণ (স্রোতপন্ন) আছে, ‍দ্বিতীয় শ্রমণ (সকৃদাগামী) আছে, তৃতীয় শ্রমণ (অনাগামী) আছে এবং চতুর্থ শ্রমণ (অর্হৎ) আছে। ভগবান বুদ্ধের এ অন্তিম বাণীতেই আছে যে, ‍বিদর্শন মার্গ ছাড়া অন্য কোন মার্গ নেই মুক্তি লাভের জন্য। তাহলে আমরা কেন অন্য পথে যাওয়ার চেষ্টা করব? বুদ্ধত্ব লাভ করার পূর্বে সিদ্ধার্থ কৃচ্ছ সাধন, শমথ ভাবনা ইত্যাদি অনেক কিছু দেখেছেন ও আচরণ করেছেন। তা সবই ত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করার পথ আবিস্কার করেছেন। প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রেও পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন একমাত্র আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথের নির্বাণ লাভ হবে। অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। ইহা ছাড়া বুদ্ধের ধর্ম আচরণ করা, ধর্মে উন্নত হওয়া ও সাফল্য অর্জন করা- স্থান, কাল, পাত্রভেদে অকালিক। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ এর মধ্যে সম্যক বাক্যটি সরবে না নিরবে সেটা কোথাও উল্লেখ নেই। অনেকে বলে থাকেন নিরবে ভাবনা করতে হবে এবং বার্মাও নাকি নিরবে ভাবনা করা হয়। অথচ বার্মায় এক বিশিষ্ট ধ্যানী লেখকের বইতে নিরবে ভাবনা করতে হবে বলে লেখা নেই। বরং সম্যক বাক্য প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে এবং বলতে বলা হয়েছে। ইহা ছাড়া আমরা কোন রাষ্ট্র বা কোন লিখক কি লিখছে এগুলি আমরা যাচাই করতে যাব কেন? স্বয়ং বুদ্ধের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করলে তো হয়। এ অনুসরণ করতে গিয়ে যাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তাঁদের বিবিধ কথা, বিবিধ আলোচনা, বিবিধ সমালোচন। সত্যিকারেই শুদ্ধ আচরণ করলেই প্রতিক্রিয়া আসবে। তাই বলে এখানে কাউকে বলতে হচ্ছে না আওয়াজ করে বলতে হবে। আওয়াজ যদিও বা কারো কাছে থেকে বের হয় পাশের কেউ শুনলে ‘শুনছি’ স্মৃতি করতে হবে। আর যিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন বা ‍যিনি সংস্কার নিরোধে মগ্ন আছেন তাঁর কর্ণ কুহরে এ শব্দ প্রবেশ করবে না। আর একটি উপমা উল্লেখ করা যাক কেউ যদি শব্দ দূষণের জন্য গভীর জঙ্গলে ধ্যান আচরণ করেন সেখানে বন্য পশুর গর্জন শুনা যায় তখন এটা কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে? অথবা কেউ যদি ভাবনায় এসে স্বর্গের বাদ্য বাজনা বা নরকের তান্ডবলীলার শব্দ শুনে তখন তাঁর কী করণীয় হবে? এ সমস্ত শুদ্ধ আচরণের প্রতিক্রিয়া স্মৃতির মাধ্যমে নিরোধ করতে পারলেই সংস্কার নিরোধ হবে এবং ভাবনার অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে। বুদ্ধ অন্তিম সময়ে অন্তিম বাক্য হিসেবে চুরাশি হাজার ধর্ম স্কন্ধকে এক বাক্যে প্রকাশ করে বলেছিলেন-
“হন্দদানি ভিকখবে আমন্তযামি বো, বযধাম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা তি”-ভিক্ষুগণ! সংস্কার সমূহ ক্ষয়শীল, অপ্রমাদের সহিত সম্পাদন কর। বুদ্ধের এহেন মূ্ল্যবান এবং প্রয়োজনীয় বাণী আচরণ/ অনুশীলন করছি কি?
এসব গবেষণায় বর্তমান সমাজে দেখা যায় কিছু কিছু নানা উপাধিতে ভূষিত পরিচয় দানকারী যেমন পন্ডিত প্রবর, বহু শাস্ত্রজ্ঞানে অভিজ্ঞ, সংগঠক এবং নানা অভাবনাকারীগণ কর্তৃক ‍উপাধি লাভীগণ যারা বিদর্শন ভাবনায় অনভিজ্ঞ তাঁদের মুখে ও লিখায় বিদর্শনাচার্যের প্রতি কটাক্ক, কটু ভাষায় অযৌক্তিক, অযাচিত মত প্রকাশ করেন। বুদ্ধ বলেছেন- পচ্চতং বেদিতব্বো বিঞঞূ। প্রত্যক্ষতব্য জ্ঞানই বুঝা যায় জ্ঞানীর ক্ষেত্র। তাঁদের লেখায় দেখা যায় একজনের থেকে শুনা কথা এক জায়গা থেকে দেখার অভিজ্ঞতা। অধিকন্তু বুদ্ধ বাণীর রেফারেন্স অপেক্ষা অন্য জনের রেফারেন্স-ই তাদের লেখার প্রধান খোরাক হিসেবে দেখা যায়। অথচ নিজের কোন ধ্যান বা ভাবনার অভিজ্ঞাতার ক্ষেত্র পরিলক্ষিত হয় না। যাদের কাছে শাস্ত্র জ্ঞান আছে অথচ ভাবনার জ্ঞান নেই বুদ্ধ তাদের রাখাল বালকের সাথে তুলনা করেছেন, যারা গাভীর পরিচর্যা করেন কিন্তু গোরস পানে অসমর্থ হয়। আর যারা ভাবনাও করেছেন তাঁরা যে কি ভাবনা করেছেন তা এক এক জনের মন্তব্য শুনলে আশ্চার্য লাগে। সত্যি কথা এসব মন্তব্য বুদ্ধের পরামর্শের সাথে কোন মিল নেই। অনেকে আবার বার্মা, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ভাবনা আচরণ দেখেছেন অথচ কোন ভাবনার আচরণ তা জানেন না। বিভিন্ন দেশের রেফারেন্স দিয়ে তো দর্শন বিদর্শন চলে না। এটি নিজের জ্ঞানের বুঝার বিষয়। নিজস্ব অভিজ্ঞার ক্ষেত্র। অধিকন্তু বুদ্ধ বলেছেন-দেহেহি বুদ্ধং বসন্তনই জানই” অর্থাৎ এই দেহের ভিতরই বুদ্ধ বা জ্ঞান বিরাজমান কিন্তু অবোধেরা তা জানেনা। তাই জন কিংবা বিভিন্ন দেশ প্রভৃতি রেফারেন্স ইত্যাদি অপেক্ষা বুদ্ধের সম্যক দর্শন-বিদর্শন এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতাই শ্রেষ্ঠ।
অনেকে বিদর্শনাচার্য তেমিয়ব্রত বড়ুয়া মহোদয়ের হাট বাজারের ন্যায় হৈ চৈ হট্টগোলের কারখানা, মাছের বাজার কিংবা বৈদ্যের বাড়ীর কথা উল্লেখ করেছেন। যারা এ সমস্ত মত পোষণ করেন তাদের ধ্যানের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট সন্দেহ জনক। আবার তাদের অনেকের আচার্য ‍কিংবা ভাবনাকারীও নয়। জীবনে কোনদিন নেত্র নিম্মীলন করেননি এরূপ লোকের সংখ্যাও এ পর্যায়ে কম নয়। অথচ মানুষের বিদর্শন ভাবনা বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং নিজের শাস্ত্রজ্ঞানসমূহকে জন সম্মুখে উপস্থাপিত করার বৈষয়িক মানসিকতার তাদের এসব মন্তব্য সত্যিই দুঃখজনক। অধিকন্তু হীন কাজ নয় কী? একমাত্র প্রত্যক্ষতব্য জ্ঞানই এসব সমস্যার কিংবা মতামতের সমাধান দিতে পারে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের বিদর্শনাচার্য মহোদয় সব সময় আহ্বান দিয়ে রেখেছেন যদি কেউ বিদর্শন ভাবনা আচরণ সম্পর্কে কোন সন্দেহ কিংবা সমস্যার মুখোমুখি হন তবে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক আমাদের আচার্য মহোদয়ের সাথে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ রইল এবং অযাচিত কথাবার্তা বলে নিজের এবং অপরের অন্তরায়ের কারণ হবেন না। পুনঃ আমাদের যেন এরূপ বক্তব্য প্রকাশ করতে না হয়।
ইদানিং কালে অনেক বক্তা বা গবেষক বুদ্ধের ধর্মের আচরণক দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলেছেন। একটি গৃহীদের জন্য দান, শীল, ভাবনা এবং অন্যটি ভিক্ষুদের জন্য শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। প্রশ্ন হলো উনারা আসলে বুদ্ধের ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃষ্টরূপে গবেষণা করেছেন কি-না? তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহা উপাসিকা বিশাখা, অনাথপিন্ডিক শ্রেষ্ঠী, কৃশাগৌতমীসহ আরও অনেকের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা সকলেই গৃহী ছিলেন এবং স্রোতাপত্তি ফল লাভ করে গৃহী অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। এখানে জানা দরকার দান, শীল, ভাবনা কুশল কর্ম সম্পাদনের দশবিধ কর্মপথের মাত্র তিনটি কর্মপথ। এই তিনটি ছাড়া আরও সাতটি কর্মপথ আছে। যেমন- সেবা, সন্মান, পূন্যদান, পূন্যদানানুমোদন, ধর্মদেশনা, ধর্মশ্রবণ এবং দৃষ্টি ঋজু কর্ম। কুশল কর্মের আচরণে প্রাণীগণের কুশল সংস্কার উৎপন্ন হয়। আর বুদ্ধ বলেছেন-“সব্বে সংখ্করা দুক্খাতি” অর্থাৎ সকল সংস্কার দুঃখময়। বুদ্ধের ধর্ম দুঃখ নিরোধের ধর্ম সুতরাং এই দুঃখ নিরোধের ধর্ম যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অর্থাৎ শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার আচরণ তা বুদ্ধের নব আবিষ্কার এবং ইহা সাবজনীন। এখানে দ্বিধা বিভক্তির কোন অবকাশ নেই। জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হোক বা হোক প্রাণীগণ কুশল, অকুশল ইত্যাদি কর্ম করবেই। কিন্তু শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার আচরন তথা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের আচরণ বুদ্ধের আবির্ভাব ব্যতিত অসম্ভব। অধিকন্তু গবেষণায় দেখা যায় প্রত্যয় সংগ্রহে দুটি বিষয় (১) প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি, (২) প্রস্থান নীতি। প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি অনুযায়ী “অবিদ্যার প্রত্যয়ে সংস্কার জন্মদানকারী সবগুলো অবিদ্যা তাই দান, শীল, ভাবনা কিংবা দশবিদ কুশল কর্মপদ অপেক্ষা শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের আচরণ অর্থাৎ বিদর্শন ভাবনার বুদ্ধের ধর্ম এবং ইহা অত্যন্ত সার্বজনীন।
ভগবান বুদ্ধ বিভিন্ন সুত্র দেশনা করেছেন বিভিন্ন কারণ উপলক্ষ করে। যেখানে জগককুল তাপিত, নিপীড়িত, বিক্ষদ্ধ এবং বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ সেখানে বুদ্ধ তাঁহার এই সূত্রাবলী দেশনা করেছেন। সূত্রপাঠ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলে পূণ্য সঞ্চয় হয়। কিন্তু সতিপট্ঠান সূত্র দেশনা করা হয়েছে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে এবং বিশেষ সময়ে অনুশীলনের জন্য। বর্তমানে মানুষ সকলে মুক্তিকামী। দুঃখ মুক্তির একমাত্র পথ বিদর্শন ভাবনা। সতিপাট্ঠান সূত্র মতে শমথ ভাবনা করে প্রতিসম্ভিদা লাভ সহ অর্হত্বফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় অতীত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে এই সূত্র অনুশীলন করে মুক্তি পাওয়া দুরের কথা মার্গ লাভ ও সম্ভব হবে না। আবার শ্রবণ জনিত পুণ্য মুক্তিকামীদের নিস্প্রোজন। যেহেতু পুণ্য সঞ্চয় সংস্কার সৃষ্টি করে এবং তাও আবার নিরোধ করতে হবে। নির্বাণ লাভ করতে হলে বিদর্শন ভাবনার প্রয়োজন। বর্তমানে বিদর্শন ভাবনা ছাড়া শমথ ভাবনা নির্বাণের ‘অন্তরা’। অতীতে তাহা দেখা যায় দেবদত্তের ঘটনায়। কাজেই সতিপাট্ঠান সূত্রও ‘অন্তরায়’।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, বুদ্ধের ভাষায় এবং ধর্মগুণের শেষ গুণ –পচ্চেতং বেদিতব্বো বিঞ্ঞূ। প্রত্যক্ষতব্য গুণই শেষ গুণ। কেহ যদি ভূমিতে অবস্থান করে একতলা বা কিংবা ততোধিক ভবনের ছাদের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করতে চায় তবে তা সম্ভব। সেরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে চাইলে তাকে সেই সমতলে অবস্থান করতে হবে। ঠিক তদ্রুপভাবে ধ্যানহীনরা, ধ্যানীদের বুঝার সাধ্য নাই। তাই সঠিক পদ্ধতিতে বিদর্শন ভাবনা আচরণ করে নিজের অধিগত জ্ঞান দিয়েই বিচার করা বাঞ্চনীয় বলে মনে করি। নিজেও আচরণ করব না অপকেও আচরণে বিপথে পরিচালিত করব এরূপ উদ্দেশ্য কখনও মহত্ত্বেও দাবী রাখে না। তাই সবাইকে বিদর্শন ভাবনার সঠিক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এটিই কাম্য। সকলের চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারণা পরিশুদ্ধ হোক এবং সঠিক ক্ষেত্র বাছাইয়ের উপযুক্ত হোক।
‘সকল প্রাণী প্রজ্ঞার আলোর উদ্ভাসিত হোক’।