Email:-bdgunman@gmail.com


সর্বেশ্বর বাদী শিখ ধর্মগুরু 'গুরু নানক'


সর্বেশ্বর বাদী শিখ ধর্মগুরু 'গুরু নানক'-
শিখধর্ম হলো একটি সর্বেশ্বরবাদী ভারতীয় ধর্ম। খ্রিস্টীয় ১৫শ' শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাবে গুরু নানক এই ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীকালে শিখ গুরুরা এই ধর্মের প্রসার ঘটান। শিখদের ১১ জন মানব গুরু ছিলেন। তাদের সর্বশেষ গুরু হলেন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিব। গুরু গ্রন্থ সাহিব হলো শিখ গুরুদের রচনার সংকলন। প্রথম পাঁচ জন শিখ গুরু তা সংকলন করেছিলেন। শিখধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। এই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা প্রায় প্রায় ৩ কোটি। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যটি বিশ্বের একমাত্র শিখ সংখ্যাগুরু অঞ্চল। শিখধর্মের অনুগামীদের ‘শিখ’ অর্থাৎ ‘শিষ্য’ বলা হয়। 
শিখধর্মের উৎস হলো গুরু নানক ও তার উত্তরসূরিদের শিক্ষা। শিখ ধর্মবিশ্বাসের মূল কথাটি গুরু নানক এইভাবে জ্ঞাপন করেছেন- 'সত্য অনুভবের চেয়ে বৃহত্তর কিছুই নেই। সত্যময় জীবন বৃহত্তর মাত্র।' শিখ শিক্ষায় সব মানুষের সমত্ব এবং জাতি, কর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো রকম বৈষম্যের বিরোধিতায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিখধর্মে গৃহস্থ জীবনযাপনে উৎসাহ দেয়া হয়।
শিখধর্ম সর্বেশ্বরবাদী এবং প্রকাশিত ধর্ম। শিখধর্মে ‘ঈশ্বর’ ধারণা হলো 'ওয়াহিগুরু'– যা নিরাকার, অনন্ত ও দৃষ্টির অগম্য। অর্থাৎ, যা চর্মচক্ষে দেখা যায় না; নিরঙ্কর, অকাল ও অলখ। শিখ ধর্মশাস্ত্রের শুরুর অক্ষরটি হলো ‘১’– যা ঈশ্বরের বিশ্বজনীনতার প্রতীক। শিখ শাস্ত্রমতে, ঈশ্বর হলেন সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান। তাকে ‘ইক ওঙ্কার’ শব্দের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। শিখরা বিশ্বাস করেন, সৃষ্টির পূর্বের শুধু ঈশ্বরই ছিলেন এবং তার হুকুমে সবকিছু ছিল। ঈশ্বরের যখন ইচ্ছা হলো তখন সমস্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো। শুরু থেকেই ঈশ্বর মায়া বা মানুষের সত্যতার ধারণা প্রতি ‘আকর্ষণ বা আসক্তি’ নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। হরমন্দির সাহিব (লোকমুখে স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত) হলো শিখদের একটি পবিত্র ধর্মস্থান।
অন্যান্য ধর্মের তুলনায় শিখধর্মে ‘ঈশ্বর’ ধারণা একটু আলাদা রকমের। এটি ‘ইক ওঙ্কার’ বা ‘এক চিরন্তন’ বা ‘সর্বব্যাপী সত্ত্বা’ নামে পরিচিত। এটির অর্থ ‘ঈশ্বর’। এটি গুরুমুখী হরফে পাওয়া যায়। এই সত্ত্বার কোনো লিঙ্গের উল্লেখ শিখধর্মে নেই। এটি ‘অকাল পুর্খ’ (সময় ও বিশ্বের অতীত) এবং ‘নিরঙ্কর’ (নিরাকার)। এছাড়া, নানক লিখেছেন যে, একাধিক বিশ্বে তিনি প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।
নানক আরও লিখেছেন যে, ‘অকাল’কে বোঝা মানুষের অসাধ্য। তবে একই সময়ে এটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতও নয়। ‘অকাল’ সকল সৃষ্টিতে সর্বব্যাপী (‘সর্ব ব্যাপক’) এবং আধ্যাত্মিকভাবে যারা জাগরিত হন তারা তাকে সর্বত্র দেখতে পান। ঈশ্বরকে ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বা ‘হৃদয়ে’র দ্বারা দেখার ওপর নানক জোর দিয়েছেন। স্বর্গীয় জীবনে জাগরিত হওয়ার জন্য ভক্তরা ধ্যান করবে– এমন বিধান ছিল তার। গুরু নানক ধ্যানের মাধ্যমে সত্যের প্রকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বার বার ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সেতুটি গড়ে ওঠে বলেই তিনি মনে করতেন।
গুরু নানকের শিক্ষা স্বর্গকে সর্বশেষ গন্তব্য বলে না। তার মতে অকালের সঙ্গে মিলনের ফলে মানুষ মুক্তি পায় বা ‘জীবন্মুক্ত’ হয়। গুরু গোবিন্দ সিংহ বলেছেন, মানব জন্ম সৌভাগ্যের। তাই সবাইকে জীবনকে কাজে লাগাতে হবে। শিখদের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যায় পুনর্জন্ম ও কর্মবাদের শিখ ধারণা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধারণার অনুরূপ বলে উল্লিখিত হয়েছে কি না তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও প্রকৃতক্ষেত্রে তা নয়। শিখধর্মে কর্ম হলো ‘ঈশ্বরের করুণা ধারণার দ্বারা গৃহীত’। গুরু নানক লিখেছেন, কর্মের প্রভাবে দেহের জন্ম হয়, কিন্তু মুক্তিলাভ হয় করুণায়। ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে শিখরা মায়ার কুপ্রভাবকে এড়িয়ে যাবে। মনকে চিরন্তন সত্যে স্থির রাখার জন্য ‘শবদ কীর্তন’, ধ্যান, ‘নাম’ ও মানবজাতির সেবা করবে। শিখরা বিশ্বাস করেন ‘সৎসঙ্গ’ বা ‘সধ সঙ্গত’ হলো পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভের একটি অন্যতম প্রধান পন্থা।
মায়া হলো একটি সাময়িক কল্পনা বা ‘অসত্য’। এটি হলো ঈশ্বর ও মোক্ষলাভের প্রচেষ্টার পথে অন্যতম প্রধান বিচ্যুতি। জাগতিক আকর্ষণ শুধু কাল্পনিক সাময়িক দুঃখ ও তুষ্টিবিধান করতে পারে এবং তা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে। নানক অবশ্য মায়াকে শুধু জগতেরই অসত্যতা বলেননি, জগতের মূল্যেরও অসত্যতা বলেছেন। শিখধর্মে অহংকার, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও কাম – এই পাঁচটি ‘পাঞ্জ চোর’ হিসেবে পরিচিত। শিখরা মনে করেন, এগুলি মানুষকে বিচ্যুত করে এবং এগুলি ক্ষতিকারক। শিখদের মতে, জগতে এখন কলিযুগ অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ চলছে। কারণ, জগত মায়াকে ভালবেসে মায়ার প্রতি আসক্ত হয়ে সত্যভ্রষ্ট হয়েছে। মানুষের ভাগ্য ‘পাঞ্জ চোরে’র কাছে পরাহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের থেকে মানুষের বিচ্যুতি ঘটে এবং একমাত্র গভীর ও নিরন্তর ভক্তির মাধ্যমেই সেই অবস্থার উন্নতি সম্ভব।
গুরু নানকের মতে, মানব জীবনের লক্ষ্য হলো অকালের (সময়াতীত ঈশ্বর) সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। অহংকার এই যোগসূত্র স্থাপনের পথে বড়ো বাধা। গুরুর শিক্ষা গ্রহণ করে নাম গ্রহণের অহংকারের বিনাশ ঘটে। গুরু নানক ‘গুরু’ শব্দটির অর্থ করেছেন ‘আত্মা’। গুরুই জ্ঞানের উৎস ও মুক্তি পথের সহায়ক। ‘ইক ওঙ্কার’ হলো সর্ব পরিব্যপ্ত। গুরু ও অকাল অভিন্ন এবং এক। সত্যের নিঃস্বার্থ সন্ধানে ব্যক্তিকে গুরুর সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধানকারী বুঝতে পারেন, দেহের মধ্যে অনুসন্ধানকারী/অনুগামী এবং শব্দ রূপী চৈতন্যই হলেন সত্যকারের গুরু। মানব শরীর শুধু সত্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের সেতু। সত্য একবার ব্যক্তির হৃদয়ে প্রজ্বলিত হলে, অতীতের সকল ধর্মের সারকথা ব্যক্তি বুঝতে পারেন।
গুরু নানক ধ্যানের সময় কীর্তন শোনা এবং ভক্তিপূর্ণ চিত্তে সর্বোচ্চ সময়াতীত ঈশ্বরের মাহাত্ম্য কীর্তন করাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মনে করতেন। শিখদের তিনটি প্রভাতী প্রার্থনা হলো জপজি সাহিব, জাপ সাহিব ও তব-প্রসাদ সাভাইয়ে। দীক্ষিত শিখরা খুব ভোরে উঠে ধ্যান করেন এবং তারপর প্রাতঃরাশের পূর্বে নিতনেমের পঞ্চ বাণীর সবগুলি আবৃত্তি করেন।
শিখদের ধর্মানুশীলনের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো ঈশ্বরের পবিত্র নাম স্মরণ। নাম জপো (পবিত্র নাম জপ) বা নাম সিমরণ (নাম জপের মাধ্যমে পবিত্র নাম স্মরণ) পদ্ধতিতে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করা হয়। ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে ঈশ্বরের নাম বা বীজ অক্ষর সোচ্চারে জপ করার প্রথা থাকলেও, গুরু নানক ব্যক্তিগতভাবে নাম জপের পক্ষপাতী ছিলেন। গুরু নানকের আদর্শ ছিল নামের প্রতি ব্যক্তিসত্ত্বার পূর্ণ অভিপ্রকাশ ও ধর্মের পূর্ণ প্রকাশ। গুরু নানকের মতে, নাম সিমরন সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে করলে পাঁচটি স্তর পার হয়ে 'ঈশ্বরের দিকে ও ঈশ্বরের মধ্যে অগ্রসর হওয়া যায়। স্মরণের সর্বশেষ পর্যায়টি হলো সচ খণ্ড (সত্যের রাজত্ব)। এখানেই ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটে।
সেবা ও কার্য ছাড়া ধ্যান নিষ্ফল। শিখরা নিঃস্বার্থ সেবার উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেবা ও দাতব্য কার্যের ফলে হউমাই বা অহংকারের বিনাশ ঘটে। শিখধর্মে সেবা তিন প্রকার। যেমন- 'তন' বা দৈহিক সেবা, 'মন' বা মানসিক সেবা (যেমন অন্যের সাহায্যার্থে অধ্যয়ন) ও 'ধন বা আর্থিক সেবা। গুরু নানক কিরত করো ধারণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এই ধারণাটি হলো কর্ম, পূজা ও দাতব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন এবং সব মানুষের অধিকার রক্ষা করা। চড়দি কলা বা জীবন সম্পর্কে আশাবাদী ও সরল ধারণা গ্রহণের জন্য শিখদের উৎসাহ দেয়া হয়। শিখধর্মে ভাণ্ড চক্কো ভাগ করে নেয়ার ধারণার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে শিখ গুরদ্বারাগুলিতে খাবার বণ্টন করা হয় (লঙ্গর), দান করা হয়, সমাজ সেবামূলক কাজ ও অন্যান্য সেবামূলক কাজ করা হয়।
শিখধর্ম ন্যায়, নিরামক ন্যায় ও দিব্য ন্যায়কে নৈতিকতার যে কোনো বিষয়ের মানদণ্ড মনে করে। পাঞ্জাবি ভাষায় 'নিয়াউ' শব্দটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই শব্দটির অর্থ ন্যায়বিচার। 'ধরম' শব্দটির মাধ্যমেও 'নৈতিকতার বিচারে' ন্যায়কে বোঝানো হয়ে থাকে। ধরমের প্রতি আক্রমণ হলো ন্যায়বিচার, সত্যতা ও সাধারণভাবে নৈতিকতার ওপর আক্রমণ। দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিংয়ের মতে, শান্তি স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে যখন শব্দের গুরুত্ব থাকে না, তখন অসির ঝলকানিই আইনসম্মত। তখন তরবারি বের করা ন্যায়সম্মত। শিখধর্মে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। অন্যান্য ধর্মে যখন আধুনিককালে নারী পুরোহিতের জন্য দাবি উঠছে, শিখধর্মে প্রথম থেকেই ধর্মস্থানে মহিলারা প্রার্থনায় অগ্রণী ভূমিকা নিতেন।