Email:-bdgunman@gmail.com


বৌদ্ধ সাধনা পদ্ধতি সমাচার নিবন্ধ সম্পর্কে উত্থাপিত সমস্যার সমাধান


বিগত ২৫৫২ বুদ্ধাব্দ, ২রা কার্তিক ১৪১৫ বাংলা ১৭ই অক্টোবর ২০০৮ইং বোধিপাল আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র কার্যনির্বাহী কমিটি যুব কর্তৃক “প্রজ্ঞাভূমি” নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। উক্ত ম্যাগাজিনে বৌদ্ধ সাধনা পদ্ধতি সমাচার শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। উক্ত নিবন্ধে বিদর্শন ভাবনা ও শমথ ভাবনাসহ অন্যান্য রীতিনীতি সম্পর্কীয় আলোচনা গবেষণাসহ অনেক সমস্যার সমাধান করা হয়। সমস্ত বিষয়ের মধ্যে   শুধু একটি বিষয় নিয়ে কিছু কিছু পূজনীয় ভিক্ষু, গবেষকমন্ডলী আপত্তি উত্থাপন করেন। সেই আপত্তি নিস্পত্তিকল্পে সমাধান সন্নিবেশিত করার জন্য চেষ্টা করছি।

“প্রজ্ঞাভূমি” ম্যাগাজিনের ৪নং ও ২৯নং পৃষ্ঠায়, উক্ত নিবন্ধের ‘যদি কিছু না বুঝা যায়’, তবে যোগাযোগ করে বুঝে নেয়ার জন্য আহ্বান রহিল। অধিকন্তু নিবন্ধে উত্থিত বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা থাকা সত্ত্বেও অনেকটা ক্রোধান্বিতভাবে, নিয়ম বহির্ভুতভাবে কিছু আপত্তি উত্থাপন করা হয়। শিরোনামের উপর ভিত্তি করে আমরা গবেষণার বিষয় পরিবেশন করেছি। শুধুমাত্র একটি শব্দ বা লাইন দিয়ে যদি সবার কাছে পরিবেশন করা হয় তবে সম্পূর্ন বিষয়টি ব্যাখ্যা মিথ্যার পর্যবসিত হয়।  নিবন্ধে কী কী বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কী ঘটেছে তার উল্লেখ থাকা সত্তেও একটিমাত্র লাইন দিয়ে আপত্তি দেখানো হয়েছে যার ব্যাখ্যা আমাদের পুনরায় দিতে হচ্ছে।

অত্র ভাবনা কেন্দ্রের দু’পাশে দু’টি বিহার। প্রথমটি চান্দগাঁও সর্বজনীন বৌদ্ধ ‍বিহার অপরটি চান্দগাঁও সার্বজনীন শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার। চান্দগাঁও সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শ্রীমৎ বনশ্রী মহাথেরো এম.এ মহোদয় এবং চান্দগাঁও সার্বজনীন শাক্যমুনি বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ এস.লোকজিৎ ভিক্ষু এম.এ মহোদয়। চান্দগাঁও সার্বজনীন শাক্যমুনি বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ পূজনীয় এস. লোকজিৎ ভিক্ষু এম.এ মহোদয় একটি চিঠির মাধ্যমে জানান ‍উল্লেখিত লিখায়  ‘কাজেই সতিপট্ঠান সূত্রও অন্তরায়’ এ লাইনটি ভুল হয়েছে এবং তজ্জন্য ক্ষমা চেয়ে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভুল স্বীকার করতে হবে। উক্ত চিঠি ২৮/১০/২০০৮ ইং তারিখে আমাদের হস্তগত হয় এবং ০২/১১/২০০৮ ইং তারিখে আমরা প্রাপ্ত চিঠির প্রত্যুত্তর প্রদান করি। এরপর আমাদের কাছে আর কেউ কিছু জানাননি।

বিগত ২৬/১১/২০০৮ ইং তারিখে অত্র ভাবনা কেন্দ্রের নির্ধারিত সীমাঘর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু, পরম পূজনীয় সংঘরাজ ও উপসংঘরাজসহ পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ উপস্থিত হয়েছিলেন। গভীর রাত প্রায় ১.০০ টার সময় পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ সীমাঘর প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক সেসময় চান্দগাঁও  সার্বজনীন শাক্যমুনি বিহারের মাননীয় অধ্যক্ষ শ্রীমৎ এস. লোকিজিৎ ভিক্ষু এম. এ এবং রাউজান  বিমলানন্দ বিহারের মাননীয় অধ্যক্ষ শ্রীমৎ মৈত্রীপ্রিয় ভিক্ষু এম.এ মহোদয় কর্তৃক পরম পূজনীয় সংঘরাজ ও উপসংঘরাজ ভন্তেসহ সকল ভিক্ষুসংঘের সম্মুখে সতিপাট্ঠান সূত্র সম্পর্কীত উল্লেখিত আপত্তি উত্থাপন করেন এবং ৫ মিনিটের মধ্যে এর সরাসরি জবাব প্রদানের জন্য অত্র ভাবনা কেন্দ্রের পরম পূজনীয় বিদর্শনাচার্য শ্রী তেমিয়ব্রত বড়ুয়া (বর্তমান আশিন খেমিকা)’র নিকট একরকমের চাপ সৃষ্টি করা হয়। যেহেতু এই আলোচনা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ এমতাবস্থায় পরম পূজনীয় বিদর্শনাচার্য মহোদয় অন্য একদিন এই আলোচনার ব্যবস্থা নিয়ে ঐ সময় সীমাঘর প্রতিষ্ঠার কাজ সমাধান করার জন্য বন্দনা সহকারে অনুরোধ করেন। অনেক বাগ্-বিতন্ডা ও আলোচনার পর পূজনীয় সংঘরাজ ভন্তে মহোদয়ের উপস্থিতিতে কিংবা উনার প্রেরিত কোন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সকলের সুবিধামত স্থানে ও সময়ে এ বিষয়ে বৈঠক করার প্রস্তাব অনুমোদন হয়। এ কাজটি মাননীয় এস লোকজিৎ ভিক্ষু এম.এ মহোদয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সবাই সম্মতি প্রকাশ করেন এবং উনি উক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য স্বীকৃতি জানান। কিন্তু অদ্যাবধি সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই আমরা আবার লিখে সমাধান জানাচ্ছি।

এ ব্যাপারে কেউ কেউ গোপনে বা প্রকাশ্যে, বক্তব্যে বা দেশনায়, লিখিত আকারে অত্র ভাবনা কেন্দ্র বা কেন্দ্রের বিদর্শনাচার্যের নামে অহেতুক মিথ্যা বদনাম ও অপবাদ প্রচারে লিপ্ত রয়েছেন। এসমস্ত প্রচারকদের মধ্যে বিদর্শনাচার্য ও ভাবনাচার্য কিংবা ভাবনা পরিচালক বা দক্ষ ভাবনাকারী কেন দৃষ্ট হয় না। শুধুমাত্র নির্বাণ পথের পথিককে বিপথে পরিচালিত করার নির্লিপ্ত মনোবাসনার বহিঃপ্রকাশ তাদের এরূপ প্রচারণা। এরূপ কিছু বিষয় আমরা সকলের জন্য্ উপস্থাপন করছি।

১/ বিগত ৬ই ডিসেম্বর, ২০০৮ইং পূর্ব গুজরা খেলারোবাড়ী বেণুবন সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহার, রাউজান চট্টগ্রাম হতে বেণুবন স্মারক নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। উক্ত ম্যাগাজিনে ১৫নং পৃষ্ঠায় চান্দগাঁও সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারের পূজনীয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক শ্রীমৎ বনশ্রী মহাথের মহোদয় লিখেছেন, ‘কোন কোন তথাকথিক বিদর্শনাচার্য বলেন-সতিপাট্ঠান সু্ত্ত শমথ ভাবনা, এ ভাবনায় মুক্তি নেই। এ ভাবনা নির্বানের “অন্তরায়” সতিপাট্ঠান সু্ত্ত ‍যদি নির্বাণের অন্তরায় হতো তাহলে ভগবান বুদ্ধ এ সুত্রটি দেশনা করতেন না। প্রজ্ঞাভূমি’র ৪০নং পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে, “সতিপাট্ঠান সূত্র দেশনা করা হয়েছে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে এবং বিশেষ সময়ে অনুশীলনের জন্য। বর্তমানে মানুষ সকলেই মুক্তিকামী। দুঃখ মুক্তির একমাত্র পথ বিদর্শন ভাবনা। সতিপাট্ঠান সূত্র মতে শমথ ভাবনা করে প্রতিসম্ভিদা লাভ সহ অরহৎ ফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় অতীত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে এ সূত্র অনুশীলন করে মুক্তি পাওয়া দুরের কথা মার্গ লাভও সম্ভব হবে না। আবার শ্রবণ জনিত পুণ্য মুক্তিকামীদের নিষ্প্রোয়োজন। যেহেতু পুণ্য সঞ্চয় সংস্কার সৃষ্টি করে এবং তাও আবার নিরোধ করতে হবে। নির্বাণ লাভ করতে হলে বিদর্শন ভাবনা প্রয়োজন। বর্তমানে বিদর্শন ভাবনা ছাড়া শমথ ভাবনা আচরণ নির্বাণের “অন্তরায়”। অতীতের তা দেখা যায় দেবদত্তের ঘটনায়। কাজেই সতিপাট্ঠান সূত্রও “অন্তরায়”।

উপরোক্ত উক্তি সঠিক নয়। এটি ভ্রান্ত ধারণা এবং বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের পরিপন্থি। ইহা অত্যন্ত আপত্তিকর এবং কোন প্রকৃত বিদর্শন সাধক এ ধরণের উক্তি করতে পারেন না।

২/ গত ৩০ জানুয়ারী, ২০০৯ইং সাতান্নটি অষ্টধাতু নির্মিত বুদ্ধমূর্তি বিতরণ, শীলানন্দ মহাথের, অগ্রবংশ মহাথের ও অজিতানন্দ মহাথেরো’র হীরক জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘ত্রি-জ্যোতি’ ম্যাগাজিনে ৮৮নং পৃষ্ঠায় চন্দনাইশ উপজেলার ফতেনগর বেণুবন বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ ত্রিপিটক বিশারদ ও সুদেশক পূজনীয় শ্রীমৎ বসুমিত্র মহাথের এম.এ মহোদয় ‘সতিপাট্ঠান ও বিদর্শন ভাবনা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন-“বর্তমানে কোন কোন ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছে সতিপাট্ঠান সূত্র নির্বাণ লাভের অন্তরায়। বুদ্ধের দিনে এটি প্রযোজ্য। এখন এটা প্রযোজ্য নয়। বুদ্ধের বাণী চিরন্তন, সর্বকালের সর্বদেশের হিতার্থে। এক্ষেত্রে কোন সুশীল, বুদ্ধিমান ব্যক্তি এরকমভাবে লিখা ঠিক হয়নি। সকল জ্ঞানী-গুণী, সুধীজন এজন্য প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছে। এরকম অমূলক, নিরর্থক, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ভাষণ লেখা বিজ্ঞজনের উচিত হয়নি। এজন্য লিখিতভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মনে করি। মানুষ এখন অত্যন্ত সচেতন জ্ঞানী, গুণী ও শিক্ষিত জন। তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এরকম পশুসদৃশ বাণী বলা উচিত হয়নি। শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার জন্য আমার সামান্য লেখায় তা প্রকাশ করলাম।

বিদর্শন ভাবনার জন্য কোন সূত্রটি যুক্তিযুক্ত বলে বুদ্ধ বলেছেন তাহা বলতে পারবেন কি? বিদর্শন ভাবনার মূল আলম্বন মনে মনে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন অদ্বিতীয় মন্ত্র আছে কি? দেহ ও মনে যখন যা উৎপন্ন হয় তখন তা বিশেষভাবে জপনা ব্যতীত অন্য কোন সূত্র মন্ত্র আছে কি বিদর্শন ভাবনার মধ্যে?। কোন সাধকের মন ছাড়া মন্ত্র যদি থাকে তা প্রকাশ করুণ। নচেৎ ভুল সংশোধন করুণ। সকল বিজ্ঞগণ বলেছেন বুদ্ধের মহান সতিপাট্ঠান সূত্র নির্বাণ লাভের প্রধান উপায়, সুতরাং কোন অবস্থাতেই অন্তরায় হতে পারে না। যিনি তা লিখেছেন তার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সতিপাট্ঠান সূত্র একমাত্র বিদর্শনের নিয়ামক ও পরিচয় বহন করে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই এভাবে অহেতুক ভাবপ্রবণ লেখার পরিশুদ্ধতা কামনা করছি।

৩/ ধূতাঙ্গ সাধক হিসেবে সর্বজন পরিচিত পূজনীয় শ্রীমৎ প্রজ্ঞবংশ মহাথের মহোদয় বিভিন্ন স্থানে দেশনায় আমাদের উক্ত নিবন্ধকে ভিত্তি করে অত্র ভাবনা কেন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল তথ্য  এবং অপবাদ প্রচার করেছেন।
এমনও দেখা যায় সতিপাট্ঠান সূত্র মতে অভিজ্ঞ বিদর্শনাচার্যের নিকট ভাবনা আচরণ করার জন্য আহ্বান পাওয়া যায়।
 এরকম আরো বহু গবেষক সতিপাট্ঠান সম্পর্কে একটি লাইন লেখা নিয়ে বিভিন্ন কিছু লিখেছেন-বলেছেন। যার কিছু কিছু আমাদের কর্ণগোচর হয়েছে আবার কিছু কিছু জানার ব্যবস্থা হয়নি।  এসব কারণে আমরা কিছু ইঙ্গিত দেব গবেষণা করে সমস্যা সমাধানের জন্য। মনে রাখতে হবে আমাদের এ গবেষণাটি সত্য উদঘাটনের নিমিত্তে, কাউকে আক্রমণ বা হীন করার নিমিত্তে নয়। উল্লেখিত বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছি।

১নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আপত্তিকারক লিখেছেন সুত্রটি যদি নির্বাণের অন্তরায় হতো তাহলে বুদ্ধ দেশনা করতেন না। ড. বেণীমাধব বড়ুয়া অনুদিত ‘মহাসতিপাট্ঠান সুত্তন্ত’ বইয়ের ১৩নং পৃষ্ঠায় অনুবাদক উল্লেখ করেছেন মধ্যম নিকায়ের সতিপাট্ঠান সূত্রে চারি-আর্য্য সত্যের নির্দেশ বা ব্যাখ্যা দৃষ্ট হয় না। অর্থাৎ চারি আর্য্য সত্য নির্দ্দেশ না থাকলে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের নির্দেশও নাই। তাই মধ্যম নিকায়ের সতিপাট্ঠান সূত্রও আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু এ সূত্রও বুদ্ধ ভাষিত এবং সংগীতিতে অনুমোদন প্রাপ্ত। এ ব্যাপারে বলা যায় ত্রিপিটকের অন্তর্গত বিধায় সবখানেই দুঃখ মুক্তির উপায় তথা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বিরাজমান আসলে তা নয়। তথাগত বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন বশীরভাগ অবৌদ্ধদের কাছে। তাই নির্বাণের বিষয় নয় এমন সুত্রও তিনি প্রচার করেছিলেন যেন পাপটা লঘু হয়, কুশলকর্মের আচরণ হয়। তাই সব সুত্রই নির্বাণের জন্য হবে এমন নয়।

২নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আপত্তিকারক লিখেছেন- বুদ্ধের সময়ে এটি প্রযোজ্য। যদি বুদ্ধের সময়ে প্রযোজ্য হয় তবে এখন নয় কেন তার কোন ব্যাখ্যা নেই। তিনি আরো লিখেছেন-দেহ ও মনে যখন যা উৎপন্ন তখন তা বিশেষভাবে জপনা ব্যতীত অন্য কোন সূত্র বা মন্ত্র নেই। বিদর্শন ভাবনার সাথে সম্পৃক্ততার অভাব হেতু তিনি বিদর্শন ভাবনার আচরণকে মন্ত্রের মত মনে করছেন। অধিকন্তু উনি একবার মত প্রকাশ করেছেন মনে মনে অনুসরণ করা ছাড়া বিদর্শন ভাবনার অন্য কোন মন্ত্র নেই আবার পরবর্তীতে সতিপাট্ঠান সূত্রকে বিদর্শনের একমাত্র নিয়ামক বলে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে উনার মন্তব্যে স্ববিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে। আবার উনার বক্তব্য অনুসারে যদি মনে মনে জপনা ব্যতীত অন্য কোন সূত্র না থাকে তাহলে সতিপাট্ঠান সূত্রের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?।

এখানে লক্ষণীয় যে উনাদের কারও লেখায় যথার্থ যুক্তি দেখা যায় না। শুধু সতিপাট্ঠান সূত্র একমাত্র মার্গ বলেই শেষ। সতিপাট্ঠান সূত্রেই নিজস্ব অভিজ্ঞতার কোন ক্ষেত্র বা প্রাপ্তি পরিলক্ষিত হয় না এবং আচরণ ও স্পষ্ট নয়। একটি বিষয়ের একাধিক নিবন্ধে একই বিষয়ের একাধিক মত পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও আপত্তিকারকদের একজনের সাথে অন্যজনের বক্তব্যের কোন মিল দেখা যায় না।

এখন আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করছি।

প্রথমেই বলে রাখি অন্তরায় কি? অন্তরায় কোন বাহ্যিক বিষয় নয়। মার্গলাভে যদি কোন বাধা সৃষ্টি হয়, যোগী বা ভাবনাকারী সেই বাধা অতিক্রম করতে না পারেন তখন তাকে অন্তরায় বলা হয়।

১/ বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েকজন প্রথিতযশা বৌদ্ধ গবেষক- পন্ডিতদের মধ্যে ধূতাঙ্গ সাধক পূজনীয় শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের অতীব সুপরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি দ ‘বার বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধ প্রধান দেশ শ্রীলংকাসহ  পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ পূর্বক বিভিন্ন বিদেশী শিক্ষায় জীবন ধন্য করেন। তাঁর অনুদিত “মহাসতিপাট্ঠান সুত্ত অট্ঠকথা” নামক গ্রন্থের গ্রন্থকারের কথা ও পটভূমির ৪র্থ পৃষ্ঠায় আছে-
কুরুরট্ঠবাসীনং গম্ভীর দেশনা পটিগ্গণ্হন সমত্থায……। তেসরীরং কল্লতায অনুগ্গহিত পঞ্চবলা গম্ভীর কথং পটিগ্গহেতুং সমত্থ হোতি। তেন তেসং ভগবা ইমং গম্ভীর দেসনা পটিগ্গহণ সমত্থং সম্পস্সন্তো এক বীসতিযা ঠানেসু কম্মট্ঠান অরহত্তে পক্কখিপিত্বা ইদং গম্ভীরত্থং মহসতিপাট্ঠান সুত্তং অভাসি।
অর্থৎ “কুরুরাজবাসীগণ গম্ভীর ধর্মভাষণ অবধারণে সক্ষম। তাঁদের শারীরিক সমর্থতা এবং অধিক প্রজ্ঞাবল গম্ভীর ধর্মভাষণের মমার্থ প্রতিগ্রহণে সমর্থ। তাই ভগবান তাদের এই সক্ষমতা সংদর্শন করে একুশটি উপায়ে অরহত্ত্ব লাভের উপায় তথা কর্মস্থান সংযুক্ত গম্ভীর অর্থসংযুক্ত এই সতিপাট্ঠান সূত্র দেশনা করেছেন।” যেহেতু বর্তমান বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীগণ ‍কুরুরাজ্যবাসী নয় তাই বর্তমান বিশ্বাসীরা এই সূত্রমতে আচরণ করলে তাদের কোন কিছু লাভ হবেনা। তাই অন্তরায় হবে। প্রথম যুক্তিতে এ ব্যবস্থা দেখা গেল।

২/ সতিপাট্ঠান সূত্রের প্রধান বিষয় কায়ানুদর্শন, চিত্তানুদর্শন, বেদনানুদর্শন ও ধর্মানুদর্শন। কায়ানুদর্ন গবেষণায় দেখা যায় এটি আনাপান ঈর্যাপথ, সম্প্রজ্ঞান, প্রতিকূল মনসিকার, ধাতু মন সিকার ও নব সীবত্থিকা-এ চৌদ্দ প্রকারে বিভক্ত। প্রথম হলো আনাপান স্মৃতি বা শমথ ভাবনা। আনাপান স্মৃতি ভাবনা অনুশীলনে ছয় চরিতের মধ্যে শুধুমাত্র মোহ চরিত এবং বিতর্ক চরিতের লাভ হবে। শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের লিখিত “মহাসতিপাট্ঠান সূত্রে অট্ঠকথা” গ্রন্থের পরিশিষ্ট-৭৯নং ও ৯০নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে সম্যক সম্বুদ্ধ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে চরিত নির্ণয় করা সহজ সাধ্য নয়। আবার, চরিত নির্বাচন বুদ্ধের দশবলের মধ্যে চতুর্থ বল (সার সংগ্রহ ১ম খন্ড: ১১ ও ১২নং পৃষ্টা)। যেহেতু বুদ্ধ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে চরিত নির্বাচন করা সম্ভব নয় সেখানে বর্তমানে চরিত নির্বাচন করে সতিপাট্ঠান ভাবনা নির্দেশ করাও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চরিত নির্ণয় করতে না পারলে আনাপান স্মৃতিতে লাভ হবে না। শ্রী বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী কর্তৃক লিখিত “অভিধম্মার্থ সংগ্রহ” পুস্তকের ২৬৯নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে আনাপান স্মৃতি পঞ্চম ধ্যানিক। আঠার প্রকার দোষ বর্জিত স্থানে মোহ চরিত ও বিতর্ক চরিত পুদগল আনাপান শমথ ভাবনা দ্বারা পঞ্চম ধ্যান লাভ করতে পারেন। পঞ্চম ধ্যান লাভ করতে না পারলে অর্পণা ধ্যানে উন্নীত হওয়া যায় না। পঞ্চম ধ্যান লাভসহ বিদর্শন ভাবনা আচরণে কমপক্ষে সাতদিন বা বেশীর মধ্যে সাত বৎসর আচরণ করলে হয় অর্হত্ব অথবা অনাগামী লাভ হবে। যার নাম প্রতিসম্ভিদা মার্গ। বিদর্শননাচার্য আর্যশ্রাবক শ্রীমৎ বোধিপাল শ্রামণ কর্তৃক লিখিত “লোকোত্তর প্রদীপ” গ্রন্থের ৫৩নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে শমথ ও বিদর্শন ভাবনান দক্ষ যোগী প্রতিসম্ভিদা লাভ করতে পারেন। আবার মধ্যম নিকায়ের বর্ণনা অনুসারে-এই সতিপাট্ঠানকে ‘একায়ণ মগগো’ বলা হয়েছে “প্রতিসম্ভিদা মার্গ” অনুসারে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আচরণের পূর্বাবস্থা। অর্থাৎ সতিপাট্ঠানের মাধ্যমে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গাচরণ “প্রতিসম্ভিদা মার্গ”। শ্রীমৎ ধম্মতিলক স্থবির কর্তৃক অনুদিত ‘সার সংগ্রহ’ ১ম খন্ড বইয়ের ৪৪নং পৃষ্ঠায় ‘অট্ঠান সূত্ত’-এ উল্লেখ আছে ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের ১০০০ বৎসরের মধ্যে পটিসম্ভিদাসহ অর্হৎ লাভ করা সম্ভব।

কোন মার্গ ও কোন জ্ঞান বুদ্ধের কত বৎসর পরে লাভ হবে তা উক্ত বইয়ের ৪৪নং পৃষ্ঠা বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হল-

ভিক্ষুণী স্কন্ধক বর্ণনা অনুযায়ী:
প্রতিসম্ভিদা প্রাপ্ত অরহতের সংখ্যা ১০০০ বছর
শুষ্ক বিদর্শক অরহতের দ্বারা ১০০০ বছর
অনাগামীর দ্বারা ১০০০ বছর
সকৃদাগামীর দ্বারা ১০০০ বছর
স্রোতপন্নের দ্বারা ১০০০ বছর, এইভাবে বুদ্ধের পরিনির্বাণ হতে ৫০০০ বছর সদ্মর্ম রক্ষিত হব।
অঙ্গুত্তর নিকায়ের অর্থকথা অনুযায়ী:
বুদ্ধের পরিনির্বাণের কাল হতে ১০০০ বছর প্রতিসম্ভিদা লাভ করতে পারবে।
এরপর ষড়াভিজ্ঞা ও ত্রিবিদ্যা লাভ করতে পারবে। ক্রমে তা লাভ না পেরে ‘শুষ্ক বিদর্শক’ হবে। এই প্রকারে অনাগামী ,সকৃদাগামী ও স্রোতাপন্ন হবে। অর্থাৎ নিম্নস্তরে নেমে আসবে।

আবার সংযুক্ত নিকায়ের অর্থকথা অনূয়ায়ী, বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভের পর ভিক্ষুরা প্রতিসম্ভিদা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কালক্রমে প্রতিসম্ভিদা লাভ করতে না পেরে ষড়াভিজ্ঞা লাভী ছিলেন। তাতে অসমর্থ হয়ে ত্রিবিদ্যা লাভ করেছিলেন। বর্তমানে তাও না পেরে তৃষ্ণাক্ষয় করতেছেন মাত্র। ভবিষ্যতে ক্রমান্বয়ে অনাগামী, সকৃদাগামী, স্রোতাপত্তি ফল মাত্র লাভ করিবে। কাল বিপর্যয়ে স্রোতাপত্তি ফলও লাভ করতে পারবে না। এখানে প্রত্যেকটি অর্থকথা বর্ণনায় দেখা যায় প্রতিসম্ভিদা লাভ হয় বুদ্ধের পরিনির্বাণের ১০০০ বৎসর পর্যন্ত। এখন বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভ হয়েছে ২৫৫২ বৎসর। এখনও কি সতিপাট্ঠান সূত্র দ্বারা প্রতিসম্ভিদা লাভ সম্ভব?

এখন আপনারাই বিচার করে দেখুন কে প্রকৃত বিদর্শন সাধক, তথাকথিত বিদর্শনাচার্য? সকল জ্ঞানী-গুণীজন কাকে নিন্দা করবেন? কারা পশু সদৃশ, মূর্খ সদৃশ বাণী লিখেছেন? কারাই বা অমূলক নিরর্থক, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ভাষণ লিখেছেন? সতিপাট্ঠান সূত্রে অভিজ্ঞ বিদর্শনাচার্য সৃষ্টি হয় কিভাবে? এগুলির জন্য তিনজন দায়ী: (১) ধূতাঙ্গ সাধক শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথের, (২) বো.আ.বি. ভাবনা কেন্দ্র কার্যনির্বাহী যুব এবং (৩) প্রতিবাদকারী বা আপত্তিকারী। আমরা প্রস্তাব রেখেছিলাম যে বসে, আলোচনা করে সমাধান করব। কিন্তু কী করতে কী হয়ে গেল তার কোন হদিস পাওয়ার ব্যবস্থা নাই।

বর্তামান সমাজে ধর্মের কোন বিশেষ গবেষণা নাই। গড্ডালিকা প্রবাহে চলছে সমাজ। সমাজে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ চায়না ধর্মের কোন ধরনের গবেষণা হোক। বোধ করি এতে তাদের বেশী অসুবিধা হয়, হয়ত নিজেদের লাভ সৎকারে প্রতিবন্ধকাত তৈরি হয়। এসব স্বার্থান্বেষী ও ছিদ্রান্বেষী মানুষ সমাজে এইভাবে সবসময় নিজেকে সরব রাখে। এখনই সময় ধর্মের প্রকৃত সারত্ত্ব উপলদ্ধি করার।

বলা বাহুল্য, বৌদ্ধ হোক কিংবা অবৌদ্ধ হোক, চিনুক বা না চিনুক সবাই শান্তি চায়। যারা বৌদ্ধ, যারা চিনে, তারা নির্বাণ লাভ করার জন্য উদগ্রীব। তাহলে আর সমস্যা থাকার কথা নয়; সতিপাট্ঠান সূত্রমতে চললে সাত দিনে অর্হৎ হওয়া যায়। তাই জন্মে জন্মে জন্ম পরিগ্রহ না করে সাত দিন কষ্ট সতিপাট্ঠান সূত্র মতে অনুশীলন করলে তো অর্হৎ হওয়া যায়। যদি তা না হয় তবে সাত মাস আর তাও না হলে সাত বছন সতিপাট্ঠান সূত্র মতে অনুশীলন করে অর্হত্ত্বফল লাভ করা যায়। নির্বাণ হাতের মুঠোয় এসে যায়।  কিন্তু বর্তমারে তা কেন সম্ভব হয় না? একমাত্র ‘অন্তরায়’ এর কারণ।

অতএব, উপরোক্ত আলোচনায় উহাই প্রতীয়মান হয় যে, সতিপাট্ঠান সূত্র অনুসারে ভাবনাচারণের সময়, পরিবেশ, পুদগল বর্তমানে নেই। যাহা আচরণ করে বর্তমানে মার্গলাভ অসম্ভব তাহা অবশ্যই নির্বাণের ‘অন্তরায়’ । এখানে ‘অন্তরায়’ বলাতে ত্রিপিটকে প্রতি, বুদ্ধের প্রতি কিংবা সতিপাট্ঠান সূত্রের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ বুঝায়না অথবা অপমাননাও নয়।

পরিশেষে আমাদের উক্ত নিবন্ধন সম্পর্কে সকলের ভুল ধারণা পরিসমাপ্তি হবে বলে আশা করি এবং সদ্ধর্মের পথ সকলের জন্য বিস্তৃত হোক এই প্রত্যাশা রাখি। সকলের মঙ্গল হোক,  অশান্ত মানসিকতা শান্ত হোক, সকলেই নির্বাণ মার্গে উপনীত হোক।